বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কালোবাজারে জসিমের কাছ থেকে টিকিট কিনে বিপাকে, অভিযোগ ১২ যাত্রীর

ওই দিন ট্রেনের একটি বগির ১৩ যাত্রীকে দ্বিগুণ মূল্য দিয়ে টিকিট কিনেও পড়তে হয় তোপের মুখে। ট্রেনে দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টদের প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ১৩ জন। তাই ধারণা করা হচ্ছে, টিকিটগুলো ছিল কালোবাজারে ক্রয় করা।

লালমনিরহাট থেকে ঢাকাগামী একটি ট্রেনে চড়া দামে ট্রেনের টিকিট কিনেও বিপাকে পড়েন যাত্রীরা।

হাতে টিকেট থাকা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের কাছে ‘অবৈধ যাত্রী’ সাব্যস্ত হন ওই ট্রেনে চড়া ১৩ জন।

লালমনিরহাটের বুড়িমারী থেকে ঢাকাগামী আন্তনগর ট্রেন ‘বুড়িমারী এক্সপ্রেসে’ মঙ্গলবার রাতে ঘটে এমন ঘটনা।

ওই দিন ট্রেনের একটি বগির ১৩ যাত্রীকে দ্বিগুণ মূল্য দিয়ে টিকিট কিনেও পড়তে হয় তোপের মুখে। ট্রেনে দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টদের প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ১৩ জন। তাই ধারণা করা হচ্ছে, টিকিটগুলো ছিল কালোবাজারে ক্রয় করা।

ওই ট্রেনে মঙ্গলবার নাটোর যাচ্ছিলেন নিউজবাংলার গাইবান্ধার প্রতিবেদক।

কোথায় আর কীভাবে পেয়েছেন এসব টিকিট, এমন প্রশ্নের জবাবে কেবল এক নারী ছাড়া অপর ১২ যাত্রীর প্রত্যেকের মুখে ছিল, বোনারপাড়ার ‘জসিম’ নামের এক ব্যক্তির নাম।

বুড়িমারী এক্সপ্রেস মঙ্গলবার রাত ১০টা ৫৬ মিনিটে গাইবান্ধা রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে গিয়ে বোনারপাড়া স্টেশনে প্রবেশ করে রাত ১১টা ২০ মিনিটের দিকে। সেদিন ‘ঞ’ বগিতে বেশ কিছু যাত্রী ওঠেন ওই স্টেশন থেকে।

ট্রেনে উঠেই এক নারী যাত্রীসহ চারজনের মধ্যে আসন নিয়ে বিবাদ তৈরি হয়। কারণ তাদের হাতে যে টিকিট ছিল, তার প্রতিটিতে একই আসন নম্বর।

মূলত কোনটি কার আসন, সেটিই নিয়েই বিবাদের শুরু হয়। পরে উপস্থিত যাত্রীদের সহায়তায় বিষয়টির সমাধান হয় এবং কামরার ‘ঞ’ বগির ৫, ৬, ৭ ও ১১ নম্বর আসনে বসেন বিবাদে জড়ানো যাত্রীরা।

যাত্রীদের মধ্যে বিবাদ হওয়া টিকিটে দেখা যায়, চার যাত্রীর হাতে আলাদা দুটি টিকিট থাকলেও তা ছিল মূলত দুটি টিকিটেরই প্রিন্ট কপি, যার নম্বরগুলো ছিল একই।

টিকিট দুটি ১৩ এপ্রিল একই তারিখে কেনা, যার একটিতে ঞ-৫, ৬, ৭, ও ১১ এই চারটি আসন নম্বর দেয়া আছে। আর নারীর হাতের অপর টিকিটেও রয়েছে ঞ-৫ ও ৭ ও ১১ আসন নম্বর। ওই টিকিটে যাত্রীরা বোনারপাড়া থেকে ঢাকা পর্যন্ত যেতে পারবেন।

ঘটনার এখানেই শেষ নয়। ওই দিন ঢাকাগামী বুড়িমারী এক্সপ্রেস সান্তাহার রেলওয়ে স্টেশন অতিক্রম করলে রাত একটার পর সান্তাহার-নাটোর স্টেশনের মাঝামাঝিতে ট্রেনের ‘ঞ’ বগিতে আসেন টিকিট কালেক্টর ‘টিটিই’।

ওই সময় টিকিট চেক করার একপর্যায়ে এ দুটি টিকিটসহ একই ধরনের পাঁচটি টিকিট দেখতে পান তিনি, যা দেখে ওই সব টিকিটের যাত্রীদের সঙ্গে চটে যান টিকিট কালেক্টর। রাগান্বিত হয়ে কোথায় আর কার কাছ থেকে কেনা হয়েছে এসব টিকিট, এমন প্রশ্ন করতে থাকেন তিনি।

দুই সন্তানসহ ঢাকাগামী এক নারী জানান, তিনি তার স্বামীর সহায়তায় পেয়েছেন টিকিট। তার স্বামী কীভাবে কিনেছেন, তা জানা নেই। এ ছাড়া যাত্রী শাহীন, মুকিম ও শাকিলসহ ১২ জনই বলেন জসিম নামটি।

যাত্রীদের ভাষ্য, তারা বোনারপাড়ার জসিমের কাছ থেকে দ্বিগুণ দামে কিনেছেন এসব টিকিট।

এসব টিকিট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, একই তারিখে কেনা টিকিটে আসন ছিল ১৩টি, যার মধ্যে দুটি টিকিটে আট যাত্রী এবং একটিতে দুই যাত্রী ট্রেনে চড়েন। অপর দুটি টিকিটে আসন সংখ্যা সাত দেয়া থাকলেও যাত্রী ছিলেন তিনজন।

যাত্রীদের মধ্যে পাঁচজন জানান, তারা কেউ কাউকেই চেনেন না। এ ছাড়া টিকিট ক্রয়ে যে এনআইডি, মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে এবং যাদের নামে কেনা হয়েছে, তাদের চেনেন না যাত্রীদের কেউই।

টিকিট পাঁচটির মধ্যে একটিতে দেখা যায়, ১৩ এপ্রিল কেনা টিকিটের ক্রয়কারীর নাম মো. আবদুর রাজ্জাক বেরারি। আরেকটি টিকিটে দেখা যায় টিকিট ক্রয়কারীর নাম হাওয়া আকতার হাসি।

এসব টিকিটে ঢাকাগামী যাত্রীদের মধ্যে একজন শাহিন। তার বাড়ি বোনারপাড়ায়। তিনি ফার্নিচারের ব্যবসা করেন, জরুরি কাজে ঢাকায় যাচ্ছিলেন।

তার কাছে থাকা টিকিটের আসন নম্বর ঞ-৫, ৬, ৭ ও ১১। টিকিট দেয়ার সময় তাকে বলা হয়েছে তার আসন নম্বর ঞ-৭।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে অপর তিনটি আসন কার। এ ছাড়া তার এ টিকিটে ক্রেতার নাম আব্দুর রাজ্জাক।

জানতে চাইলে যাত্রী শাহিন বলেন, ‘কয়েক দিন চেষ্টা করেও টিকিট পাইনি। পরে জসিমের থেকে বাধ্য হয়ে দ্বিগুণ দামে টিকিট কিনেছি। কিছু করার নাই। সবখানেই একই অবস্থা। যেতে হবে তো।’

‘আপনার হাতের টিকিটে আবদুর রাজ্জাক কে? এনআইডি আর এই মোবাইল নম্বরই বা কার?’

উল্লিখিত দুটি প্রশ্নের উত্তরে যাত্রী শাহিন বলেন, ‘মোবাইল নম্বর এবং এনআইডি কার জানি না। আর আবদুর রাজ্জাককেও আমি চিনি না।’

এ ছাড়া যাত্রীদের মধ্যে ওই নারীর বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়ার শিমুলতাইর গ্রামে। তার স্বামী দুলু মিয়া ঢাকায় বেসরকারি চাকরি করেন। ওই নারীর হাতে যে টিকিটটি ছিল, তাতে আসন নম্বর ছিল ঞ-৫, ৭, ও ১১ নম্বর।

ওই নারী যাত্রীর দাবি, তাকে বলা হয়েছে তার আসন নম্বর ৫ ও ৭। তাহলে কোচের ১১ নম্বর আসনের যাত্রী কে, তা নিয়ে ওই নারী বলেন, ‘ঢাকা যাওয়ার জন্য আমার স্বামী দুটি টিকিট ১ হাজার ৭০০ টাকা দিয়ে কিনেছে। স্টেশন থেকে নয়, তবে কার থেকে কিনেছে টিকিট, তা জানা নেই।’

টিকিট কেনা আরেক যাত্রী শাকিল। তার কাছে একটি নয়, ছিল দুটি টিকিট। ওই দুই টিকিটে আসন সংখ্যা আটটি। এসব টিকিটে ঢাকা যাচ্ছিলেন শাকিলসহ আটজন।

শাকিলের হাতে থাকা দুটি টিকিটই কাউন্টার থেকে প্রিন্ট করা, যার মধ্যে ১, ৪, ২৮ ও ৩০ নম্বরের চারটি আসনের একটি টিকিটে যাত্রীর নাম দেখাচ্ছে হাওয়া বেগম।

ওই হাওয়া বেগম কে জানতে চাইলে শাকিল টিটিইকে বলেন, ‘চিনি না।’

‘তাহলে তার নামের টিকিটটি তোমার হাতে এলো কীভাবে?

টিটিইর উল্লিখিত প্রশ্নের জবাবে শাকিল বলেন, ‘বোনারপাড়ার জসিম ভাইয়ের থেকে প্রতিটি টিকিট ৮০০ টাকা করে কিনেছি।’

ওই সময় টিকিট কালেক্টর গোলাম হাফিজ রিজু বলেন, “এই ‘ঞ’ বগির পাঁচটি টিকিটে থাকা ১৩ যাত্রীর প্রত্যেকেই ব্ল্যাকে টিকিট কিনেছেন। বিধি মোতাবেক তারা প্রত্যেকেই অবৈধ যাত্রী।

‘কেননা তাদের কাছে থাকা টিকিট ক্রয়ে যে এনআইডি ব্যবহার করা হয়েছে, সেই নামের বা সেই এনআইডিধারী ব্যক্তি মূলত যাত্রী নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘টিকিট কালোবাজারি যেকোনোভাবে ওই আইডি বা মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে টিকিট ক্রয় করেছেন এবং বেশি দামে বিক্রি করেছেন।’

কে এই জসিম

ওই দিন একটি বগির ১৩ যাত্রী যার কাছ থেকে কালোবাজারে টিকিট কেনার কথা জানিয়েছেন, সেই জসিমের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সাঘাটা উপজেলার রাঘবপুর গ্রামের বাসিন্দা জসিম। তিনি একসময় বোনারপাড়া স্টেশনে ব্যবসা করতেন।

রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, জসিম ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর টিকিট কালোবাজারে বিক্রির সময় বোনারপাড়া থেকে গ্রেপ্তার হন। ওই সময় তার কাছ থেকে ট্রেনের চারটি টিকিট উদ্ধার করা হয়। পরে একই তারিখে রেলওয়ে পুলিশ বাদী হয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে তার নামে মামলা করে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত জসিম মোবাইল ফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন টিকিট সব অনলাইনে। আর টিকিটে আমার নাম বা আমার নম্বর নাই। বোনারপাড়াতে মানুষকে ভালোবেসে কিছু করতে যায়া (গিয়ে) আমার নামে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। তারপর থেকে আমি অনেকটাই দূরে।’

ওই সময় তিনি বলেন, ‘বোনারপাড়া স্টেশন মাস্টার থেকে শুরু করে সবাই এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মূলত তারাই এসব টিকিট বিক্রি করে।

‘যদি কোনো সমস্যা হয়, তারা আমার (জসিম) নামটা তাদের বলতে বলে দেয়। ট্রেনে সেদিনের ঘটনা আমি শুনেছি। যাত্রীরা নাকি আমার নাম বলেছে।’

বোনারপাড়া রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার মো. খলিল মোবাইল ফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টিকিট কালোবাজারির বিষয়টি দেখার দায়িত্ব জিআরপি (রেলওয়ে পুলিশ) এবং আরপিএমপির (রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ)। তারা কী করে?

‘টিকিট এখন শতভাগ অনলাইনে। যদি কেউ আমার কথা বলে থাকে, তা মিথ্যা বলেছে। আমি জসিমকে সে রকমভাবে চিনিও না।’

কথা হয় গাইবান্ধা রেলওয়ে পুলিশের ওসি খাইরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অভিযুক্ত জসিমকে ২০১৯ সালে কালোবাজারে টিকিট বিক্রিকালে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় রেলওয়ে পুলিশ। এ অভিযোগের বিষয়টিও অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।

‘এ ছাড়া ট্রেনের টিকিট কালোবাজারে ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয়ে সবসময়ই সজাগ রয়েছে রেলওয়ে পুলিশ।’

এ বিষয়ে ডিভিশনাল ট্রাফিক সুপারিনটেনডেন্ট (লালমনিরহাট) আবদুল্লাহ আল মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি বন্ধ করতে শতভাগ টিকিট এখন অনলাইনে। অনেক সময় সিন্ডিকেটরা এক সিটের টিকিট একাধিক ব্যক্তিকে দিয়ে থাকেন।

‘সে ক্ষেত্রে ট্রেনে থাকা সংশ্লিষ্টরা যাদের টিকিটের সাথে নাম বা এনআইডির মিল পায়, তাদেরকে ওই সিটে বসিয়ে দেয় এবং অন্যজনকে জরিমানাসহ নতুন টিকিট করে দেয়া হয়।’

ওই সময় স্টেশনের আশপাশে টিকিট কালোবাজারি থাকার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘স্টেশনের আশপাশে, চিপায়চাপায় ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির একটি সিন্ডিকেট আছে। যারা টিকিট কেনে, তারাও বিষয়টি জানে। বিষয়টি একটি ফৌজদারি অপরাধ। ওই সব ধরার দায়িত্ব পুলিশের।’

ট্রেনের টিকিট শতভাগ অনলাইনে দেয়া সত্ত্বেও এখনও কালোবাজারি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি স্বীকার করে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘একজন কৃষক যখন কোনো দোকানে টিকিট নিতে যান, আর সেই দোকানদার যদি সিন্ডিকেট হয়, তাহলে তার আইডি দিয়েই ওরা চারটি টিকিট ক্রয় করে বেশি দামে বিক্রি করে থাকে।’

যাত্রীদের সচেতন করে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘নিজেদের এনআইডি দিয়ে টিকিট ক্রয় করে নিজেদেরই যাত্রা করতে হবে। অন্যের আইডি দিয়ে ক্রয় করা টিকিট নিয়ে ট্রেন ভ্রমণ বৈধ নয়। আমরা সবসময়ই যাত্রীদের এ ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকি।’

এ বিষয়ে সৈয়দপুর রেলওয়ে পুলিশ সুপার ফারহাত আহমেদ জানান, এ বিষয়ে অবশ্যই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।

তিনি বলেন, ‘পুলিশ কালোবাজারি নির্মূলে শতভাগ চেষ্টা করছে; তৎপর রয়েছে। টিকিট সিন্ডিকেট ধরতে রেলওয়ে পুলিশের আন্তরিকতার কমতি নেই।’

এ বিভাগের আরো খবর