১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠান। হাতে তেমন সময় নেই। কেউ নিয়ে এলেন চেয়ার-টেবিল, কেউ নিয়ে এলেন বাঁশ-খুঁটি।
বাড়িতে পরার নতুন কাপড় ব্যবহার করা হলো প্যান্ডেল ঘেরাওয়ের কাজে। আগের দিনের অর্ধেক সময় আর রাত জেগে পাহারা দেয়া হলো মেহেরপুরের তৎকালীন বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন।
শুরুটা শপথের অনুষ্ঠান থেকে হলেও মুক্তিকামী মানুষকে সহযোগিতা করতে গিয়ে কেটে গেল যুদ্ধের পুরোটা সময়।
সময় গড়িয়েছে, মত-পথ পাল্টেছে। তবে একাত্তরের ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক সেই শপথ অনুষ্ঠানের পেছনের কারিগরদের কেউ মনে রাখেনি। খোঁজ নেয়নি কেউ।
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তো দূরে থাক, স্থানীয়ভাবেও তারা পাননি যথাযথ সম্মান। এই আক্ষেপ নিয়ে কেউ পাড়ি দিয়েছেন পরপারে, কেউবা মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।
মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণরত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য। ছবি: নিউজবাংলা
কথাগুলো বঙ্গবন্ধুর ডাকে গঠিত বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটি নিয়ে।
জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার নির্দেশনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন কয়েক যুবক।
সে সময়ের এমএনএ ছহি উদ্দীন বিশ্বাস এবং এসডিও তৌহিক-এলাহি চৌধুরীর পরামর্শে তারা ঐতিহাসিক শপথের সব আয়োজন করেছিলেন। শপথ অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, বাইবেল পাঠ, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনসহ বিভিন্ন কাজে যারা যুক্ত হয়েছিলেন তাদেরকে আম্রকাননে নিয়ে এসেছিলেন সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা।
প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের পর গোটা এলাকা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। তারপরও জীবনের পরোয়া না করে সংগ্রাম কমিটির অকুতোভয় সদস্যরা ত্রাণ সংগ্রহের কাজ করেছিলেন। তাদের অনেকে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সম্মান না পাওয়ার কষ্ট নিয়ে ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। দুই-একজন যারা বেঁচে আছেন তারা মৃত্যুর আগে রাষ্ট্রের স্বীকৃতিটুকু পেতে চান।
মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স। ছবি: নিউজবাংলা
সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য বল্লভপুর গ্রামের বয়োবৃদ্ধ থিওফিল মণ্ডল বলেন, ‘প্রাণের টানে প্রতি বছর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে ছুটে আসি। পঁচাত্তর-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ১৯৭৬ সালে কেউ মুজিবনগর দিবস পালন করতে আসেনি। আমরা মাত্র ১৯ জন লোক বাগানে গিয়ে মুজিবনগর দিবস পালন করেছিলাম।’
রাষ্ট্রীয় সম্মান-স্বীকৃতি না পাওয়ার আক্ষেপ করে এই বীর মুক্তিযাদ্ধা বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুনেছিলাম হাতেগোনা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন। পরবর্তীতে দেখি শতাধিক মানুষ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পাচ্ছে। তারপরও সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা অবহেলিত।’
একই কথা জানালেন মানিকনগর গ্রামের বয়োবৃদ্ধ দোয়াজ উদ্দীন মাস্টার। তিনি বলেন, ‘সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা সব আয়োজন করেছিল। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করার জন্য আমার ছাত্র দারিয়াপুর গ্রামের বাকের আলীকে ডেকে নিয়ে আসি। সে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছে। এছাড়াও সংগ্রাম কমিটির আরেক সদস্য আব্দুল মোমিন চৌধুরী স্বীকৃতি পেয়েছেন।’
সংগ্রাম কমিটির সদস্যসহ যারা সেদিন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাদের সবার স্বীকৃতি দাবি করেন তিনি।
মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ। ছবি: নিউজবাংলা
বাংলা একাডেমী প্রণীত ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস: মেহেরপুর জেলা’ গ্রন্থের মাধ্যমে মূলত সংগ্রাম কমিটির বিষয়টি সবার নজরে আসে। এই গ্রন্থের লেখক মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত দেশবরেণ্য কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশিদ বলেন, ‘অনিবার্য মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার হাত বাড়ানো এসব মানুষের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়াটা খুবই প্রয়োজন। তারা শুধু শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজনই করেননি, কুষ্টিয়া অঞ্চলে সম্মুখ যুদ্ধে সব রসদ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন জীবন বাজি রেখে।
বাগোয়ান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আয়ুব হোসেনও সংগ্রাম কমিটির সদস্য ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাবি করেন।
তবে আশার কথা শুনিয়েছেন মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘ঐতিহাসিক মুহূর্তে ঐতিহাসিক ভূমিকার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাদের সবাইকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে উত্থাপন করা হয়েছে।’