ঈদে বাবা নতুন জামা আনবে। মা আনবে খেলনা। সে অপেক্ষায় বাড়ির কাছে গাড়ির শব্দ পেলেই ছুটে যায় তিন বছরের সাজিদ।
এভাবে দিন যায়, দিন আসে। সাজিদের অপেক্ষা বাড়তে থাকে, কিন্তু গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে প্রাণ হারানো শিশুটির মা-বাবা আর আসে না তার কাছে।
শিশু সাজিদের দাদার বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার গালা ইউনিয়নের বেড়াকোল গ্রামের খাঁ পাড়ায়, যেখানে দাদা সাবেদ খাঁ ও দাদি সাহানা খাতুনের সঙ্গে থাকে সে।
সাজিদের দাদা সাবেদ খাঁ ছেলের উপার্জনের টাকাতেই সংসার চালাতেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ মানুষটি কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন অনেক আগেই, কিন্তু আকস্মিক দুর্ঘটনায় ছেলে হারিয়ে বৃদ্ধ বয়সে নতুন করে কাজ শুরু করেছেন।
অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন সাবেদ খাঁ। গত তিন বছর ধরে সংসারের হাল ধরে ছিল তার ছেলে মহিদুল ও পুত্রবধূ নার্গিস।
শাহজাদপুর উপজেলার গালা ইউনিয়নে রোববার সকালে গিয়ে জানা যায়, গাজীপুরে বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ওই এলাকার পাঁচজন। তাদের কারোর পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়।
ইউনিয়নের খাঁ পাড়ায় টিনের যে ঘরে দাদা-দাদির সঙ্গে থাকে সাজিদ, সেটির চাল থাকলেও নেই জানালা। ঘরে আসবাবপত্র বলতে একটি চোকি।
দাদির কোলে মন ভার করে ছিল সাজিদ। কাজের খোঁজে বাড়ির বাইরে গিয়েছিল শিশুটির দাদা।
দাদি সাহানা খাতুন অশ্রুসিক্ত হয়ে দরজার কোনায় সাজিদকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন।
এ বৃদ্ধা নিউজবাংলাকে বলেন, “নাতি বারবার শুধু মা-বাবার কথা বলে। ও বলে, ‘ঈদে বাবা আসবে। আমার জন্য মাংস নিয়ে আসবে। মা আমার জন্য খেলনা আনবে।’ আরও কত কী।
“আমি তখন মুখ লুকিয়ে কাঁদি। ছোট ছেলেটি তাই দেখে আমার থেকে দূরে গিয়ে মন ভার করে বসে থাকে। প্রতিবেশী অনেক ছোট ছেলে-মেয়েরা সাজিদকে বলে, ‘তোর বাবা-মা মারা গেছে।’ এ কথা শুনে দৌড়ে আমার কাছে আসে আর কান্নাভরা কণ্ঠে বলে, ‘আমার বাবা-মা কোথায়?’”
সাহানা আরও বলেন, ‘ছোট এ অবুঝ শিশুকে নিয়ে আমি কী করব? আমার দুই সন্তানের মধ্যে মহিদুল ছোট। বড়জন নিজের সংসার নিয়েই থাকে; আমাদের দেখে না।
‘গত তিন বছর ধরে ছোট ছেলেই আমাদের লালনপালন করছে। এখন সংসার চালাতে বৃদ্ধ মানুষটি (সাজিদের দাদা) আবারও মাঠেঘাটে ছুটছে।’
কথা হয় সাজিদের আরেক দাদা রমজান খাঁর সঙ্গে, যিনি বলেন, ‘এই পরিবার খুবই অসচ্ছল। ছেলের মৃত্যুর পর নাতিকে নিয়ে কোনোমতে দিন পার করছে। ঈদের আনন্দ আর কী? ঠিকমতো ইফতারই করতে পারেন না। গতকাল পানি দিয়ে ইফতার করেছেন।’
সাজিদের দাদা সাবেদ খাঁ জানান, পুত্র ও পুত্রবধূর মৃত্যুর পর সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা পাননি। সোমবার একটি দলের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘সরকার যদি আমাদের পাশে দাঁড়াত, তাহলে নাতিকে নিয়ে এই বয়সে অন্তত ঠিকমতো বেঁচে থাকতে পারতাম।’
শুধু মহিদুল ও নার্গিস নন, একই গ্রামের হালদারপাড়ায় গ্যাস বিস্ফোরণে প্রাণ হারানো সোলায়মান মোল্লার পরিবারের অবস্থাও একই।
স্ত্রী শাপলা খাতুন ছাড়াও দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন সোলায়মান। স্বামীর মৃত্যুর পর একটি ছোট ঘরে তিন সন্তান আর শাশুড়ি সুখজান খাতুনকে নিয়ে বসবাস করছেন শাপলা।
তিনি জানান, তার স্বামী সোলায়মান তার ছোট ভাই উজ্জ্বল মোল্লার স্ত্রী শিল্পী খাতুন ও তাদের দুই সন্তান নিরব ও নূরনবীকে বাঁচাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। শিল্পী খাতুন ও নিরব এখনও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে রয়েছেন।
শাপলা জানান, তার স্বামী শারীরিক প্রতিবন্ধী। ঠিকমতো হাঁটতে পারতেন না। গাজীপুরে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন।
তিনি বলেন, ‘আমি অন্যের বাসায় কাজ করতাম। ঘটনার দিন ভাইয়ের বউকে বাঁচাতে গিয়ে আমার স্বামীর শরীরে আগুন লেগে যায়। ঘটনার পাঁচ দিন পর চিকিৎসারত অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। আমি এখন আমার তিন সন্তানকে নিয়ে অসহায় অবস্থার মধ্যে দিন যাপন করছি।’
এ গৃহবধূ আরও বলেন, ‘ঘটনার পরে সাত হাজার ৫০০ টাকা সহায়তা পেয়েছিলাম। আর একটি দল থেকে ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। এর বাইরে এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি।
‘২২ বছর সংসার করেই আমি আমার স্বামীকে হারালাম। পিতাহারা হলো আমার তিন সন্তান। এখন আমি তাদের নিয়ে কী করব? কীভাবে চলব?’
ওই সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন সোলায়মানের মা সুখজান খাতুন। কান্নাভরা কণ্ঠে বারবার তিনি ছেলেকে ফেরত চাইছিলেন।
নানা আকুতি করে শুধু একটি কথাই বলছিলেন, ‘আমার ছেলের মৃত্যুর পর তাকে আর চেনা যায়নি। পুরো শরীর আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।’
একই এলাকার কুটি ফকিরের ঘরে ঝুলছে তালা। স্ত্রী দুলু খাতুন আর তিন মেয়েকে নিয়ে সংসার ছিল তার।
বাবা আয়নাল ফকির ও মা জরিনা খাতুন অনেক আগেই মারা গেছেন। ঢাকায় দিনমজুরের কাজ করতেন কুটি। তার স্ত্রী দুলু খাতুন কাজ করেন স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টসে। স্বামীর মৃত্যুর পর এলাকায় এসেছিলেন একবার। পেটের দায়ে তিন সন্তানকে নিয়ে আবারও ফিরে গেছেন গাজীপুরে।
দুলু খাতুনের বড় মেয়ে রুমি খাতুনের (১৩) বিয়ে হয় অল্প বয়সে। তার মেজো মেয়ে ফাতেমা (৭) ও ছোট মেয়ে জান্নাতি (৪)।
কুটি ফকিরের চাচাত ভাই সেদেক ফকির বলেন, ‘আমার চাচাত ভাই দিন এনে দিন খেতেন। পেটের দায়ে গাজীপুরে কাজ করতেন। তিনি মারা গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন তিন সন্তানকে।
‘জানি না তাদের ভাগ্যে কী হবে? আমরাও কোনো মতে দিন পার করি। তাই ইচ্ছা থাকলেও তাদের পাশে দাঁড়াতে পারছি না। সরকার যদি তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়, তাহলে অন্তত তারা বেঁচে খেয়ে থাকতে পারত।’
এ বিষয়ে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান জানান, গাজীপুরে বিস্ফোরণে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের তালিকা অনুযায়ী পরিবারের সদস্যদের সহায়তা করা হবে। এ বিষয় কার্যক্রম চলছে।
গাজীপুরের কালিয়াকৈরের তেলিরচালা এলাকায় গত ১৩ মার্চ বিকেলে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৩৪ জন দগ্ধ হয়েছিলেন। তাদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখানে কয়েকজনকে চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র দেয়া হয়।
গ্যাস বিস্ফোরণ প্রাণ হারানো ১৭ জনের মধ্যে শাহজাদপুরের পাঁচজনসহ ছয়জন সিরাজগঞ্জের। তাদের পাশে সরকার দাঁড়াবে, এমনটিই প্রত্যাশা স্বজনদের।