দক্ষ কারিগর, প্রশিক্ষণ, সংরক্ষণ ও যথাযথ বাজারজাতকরণের অভাবে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী কাপড় খাদির বাজার। জেলায় নামে থাকলেও আসল খাদি মেলে না দোকানগুলোতে।
সময়ের বিবর্তনে খাদিতে মেশিনের ছোঁয়া লেগেছে। এতে ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে গেছে হাতে বোনা তাঁতের আসল খাদি। বর্তমানে গুটিকয়েক তাঁত টিকে আছে।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, কুমিল্লার দেবিদ্বার, চান্দিনা ও মুরাদনগর উপজেলায় হাজারেরও বেশি তাঁত ছিল। সেসব তাঁতের তৈরি কাপড় থেকে খাদির পাঞ্জাবি, ফতুয়া, কাপড় তৈরি হতো। এসব পোশাক কুমিল্লা থেকে চলে যেত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এ কারণে কুমিল্লা পরিচিত হয় ‘খাদির শহর’ হিসেবে।
সেই তাঁত এখন একেবারে কমে গেছে। তাঁতের সঙ্গে কমেছে আসল খাদিও। দিন দিন বাজার ছোট হয়ে আসায় শঙ্কা বাড়ছে তাঁতে তৈরি বস্ত্রটির বিলুপ্তির।
খাদির প্রচলন যেভাবে
খাদির ইতিহাস তুলে ধরে লেখক ও গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, “তাঁতের মেশিনটি মাটিতে গর্ত করে বসানো হতো। মাটিতে খাদ তৈরি করে মেশিনটি বসালে মেশিনের প্যাডেল চালাতে সুবিধা হতো। সেই খাদ থেকেই মূলত খাদি শব্দটির প্রচলন হয়।
“১৯২০ সালে দেশে বিলেতি পণ্য বর্জন আন্দোলন শুরু হয়। তখন খাদির প্রচার-প্রসারে ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধী কুমিল্লার চান্দিনায় আসেন। সেখানে তিনি চরকায় সুতা কাটেন। সেই থেকে খাদির প্রসার বাড়ে। পরে ১৯২২ সালে ‘ভারত তন্তু বায়’ নামে একটি সমিতি করেন। সেই সমিতি থেকে কুমিল্লার তাঁতের পোশাক ভারতে যেত।”
আহসানুল কবীর আরও বলেন, ‘একসময় কুমিল্লার চান্দিনা, দেবিদ্বারের শত শত পরিবার তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত ছিল। এখন পাঁচ থেকে সাতটি পরিবার পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ।
‘খাদিকে বাঁচাতে হলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা লাগবে। কারন খাদির সুতা তৈরি হয় তুলা থেকে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চাষিদের দিয়ে তুলা চাষ করাতে হবে। সেই তুলা থেকে সুতা তৈরি করতে হবে। এ ছাড়াও খাদির পণ্য প্রসারে খাদি ফাউন্ডেশন করতে হবে। তবেই যদি খাদি তার পুরো স্বকীয়তা ফিরে পায়।’
তাঁতের অবস্থা এখন যেমন
কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার বড়কামতা গ্রামের দুই ভাই চিন্তাহরণ দেবনাথ ও রণজিৎ দেবনাথ তাঁতের তৈরি খাদির সঙ্গে যুক্ত। স্বাধীনতার আগ থেকে পরিবারটি এতে সম্পৃক্ত।
আসল খাদির বাজার ছোট হয়ে আসা নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে চিন্তাহরণ বলেন, ‘এখন মেশিনে বোনা হয় খাদি। তাঁতের খাদি ও মেশিনের খাদি দেখতে একই রকম হলেও গুণে-মানে অনেক তফাৎ রয়েছে। এখন কুমিল্লার বাজারে তাঁতের খাদি অনেক কম। মেশিনের খাদিই বেশি।’
চিন্তাহরণের ভাই রণজিৎ দেবনাথ মনে করেন, তাঁতের তৈরি খাদির বাজার সংকুচিত হওয়ার জন্য দায়ী যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা।
তার ভাষ্য, ‘একসময় হাজার তাঁতি ছিল এ অঞ্চলে। নারীরা চরকায় সুতা কাটত। তাঁত বুনে যে আয় হতো, তা দিয়ে পরিবার চালাত।
‘এখন দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, তুলার সরবরাহ কম এবং সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় খাদির বাজার ছোট হয়ে আসছে। তাঁতিরা এখন অন্য পেশায় ঝুঁকছে।’
রণজিৎ দেবনাথ জানান, তার ছিল ৮টি তাঁত। একটি ছাড়া এখন সবই বন্ধ। শখের বশে দুই এক থান বুনেন তিনি।
স্মৃতি হাতড়ে রণজিৎ বলেন, ‘একসময় পুরো গ্রামের বাড়ি বাড়ি চরকায় সুতার কাটার শব্দে শত শত পিস থান কাপড় বেরিয়ে আসত। কতশত ব্যস্ততা ছিল তাঁতপাড়ায়।
‘কত আনন্দ-বেদনার গল্প লুকিয়ে ছিল। এখন সেই তাঁত নেই। তাঁতের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে আসল খাদি কাপড়।’
তাঁত থেকে তৈরি খাদি শিল্পকে রুগ্ন অবস্থা থেকে বের করে আনতে এখনই পদক্ষেপ না নেয়া হলে এ শিল্প বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন রণজিৎ।
খাদি কাপড়ের বর্ষীয়ান ব্যবসায়ী ও খাদিঘরের স্বত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার রাহা বলেন, ‘একসময় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এসেছিলেন আমার দোকানে। খাদির ডিজাইন পছন্দ করেছিলেন তিনি।’
শিল্পের বর্তমান অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে খাদি শিল্পে অনেক নতুন নতুন ডিজাইন এসেছে। ১৯২১ সালের প্রেক্ষাপট ও চাহিদা এক নয়। শতবর্ষের খাদি পণ্য তার গুণগত মান বজায় রেখে আধুনিকতার সংমিশ্রণে প্রতিযোগিতার বাজারে চাহিদা ধরে রেখেছে।
‘পৃথিবীর যেখানে বাঙালি কমিউনিটি আছে, সেখানে খাদি কাপড়ের প্রসার ঘটেছে। বাংলাদেশের বিদেশি দূতাবাসে খাদিসহ দেশীয় পণ্যের প্রদর্শনী করলে তা পণ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটাবে।’
কুমিল্লার শত বছরের ঐতিহ্য খাদিকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ডিসি খন্দকার মুশফিকুর রহমান জানান, খাদিকে ফিরিয়ে আনতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়কে গুরুত্বের সঙ্গে জানানোর চেষ্টা করা হবে। এ ছাড়াও কুমিল্লার খাদিকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আবেদনের চেষ্টা চলছে।