বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

৪৮ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি ও মধুমিয়া

  •    
  • ২৬ মার্চ, ২০২৪ ১১:২২

আগুনঝরা দিনে আনসারের এক জওয়ান শহীদদের মরদেহ মর্যাদার সঙ্গে দাফন করার জন্য এগিয়ে আসেন। তিনি সুনামগঞ্জের আবুল কালাম ওরফে মধু মিয়া।

একাত্তর সালে দেশের মাটিকে শত্রুমুক্ত করতে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন বাংলার দামাল ছেলেরা। যখন শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিচ্ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা, ঠিক তখন দাফন করার নির্দিষ্ট জায়গা না থাকায় সহযোদ্ধারা যেখানে পারছেন তাদেরকে কবর দিচ্ছিলেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে মরদেহ পানিতে ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন।

এই আগুনঝরা দিনে আনসারের এক জওয়ান শহীদদের মরদেহ মর্যাদার সঙ্গে দাফন করার জন্য এগিয়ে আসেন। তিনি সুনামগঞ্জের আবুল কালাম ওরফে মধু মিয়া। যুদ্ধে শহীদদের জন্য মধু মিয়া কবরের জায়গা খুঁজতে থাকেন। বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে নিজের দখলে থাকা সরকারি খাস জায়গাকেই উপযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করেন তিনি।

১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন মন্তাজ মিয়া। জামালগঞ্জের কামলাবাজ গ্রামে বাড়ি মন্তাজ মিয়ার। আনসার বাহিনীর এই তরুণ দেশ মাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করার অদম্য বাসনায় যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।

বালাট সাব-সেক্টরের এই যোদ্ধা মৃত্যুর আগে মীরেরচর গ্রামের কাঁচা মিয়াকে নিজের পাঞ্জাবি ও চশমা দিয়ে বলেছিলেন, যুদ্ধে যদি আমি মারা যাই তবে আমার বৃদ্ধ মাতাকে এই দুটো জিনিস দিয়ে দেবেন। এর কিছুদিন রেই সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন মন্তাজ মিয়া। মধু মিয়া শহীদ মন্তাজের খবর জানতে পেরে ছুটে যান তার সঙ্গী সাথী নিয়ে।

আর এই শহীদ মন্তাজ মিয়াকে দাফন করেই কার্যক্রম শুরু হয় সুনামগঞ্জ সদরের ডলুরা শহীদ স্মৃতি সৌধের। তারপর আর থেমে থাকেননি মধু মিয়া। যেখানেই খবর পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন সেখানেই তিনি ছুটে গেছেন।

বাংলাদেশ সরকারের এ অঞ্চলের এমএনএ দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরী ১৯৭১ সালের ১ সেপ্টেম্বর মধু মিয়ার কাজের স্বীকৃতি দেন। দাফন কাফনের পাশাপাশি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের হাসপাতালে পাঠানো এবং প্রত্যেক শহীদকে তাদের ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী দাফন কাফনের ব্যবস্থাসহ দাহ করার জন্য তাকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি করে দেন।

আত্মনিবেদিত মধু মিয়া তার এই মহৎ কাজের অংশীদার করতে নিয়ে আসেন মুন্সী তারু মিয়াকে, যিনি মাওলানা হিসাবে জানাজা পড়াতেন। কবর দিতে ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের হাসপাতালে পাঠাতে সাহায্য করতেন আফসার উদ্দিন, কিতাব আলী, আব্দুর রহিম, মগল মিয়া, হযরত আলী ও মাফিজ উদ্দিন। হিন্দু মুক্তিযোদ্ধাদের দাহ করতে পুরোহিত হিসাবে কাজ করার জন্য নিয়ে আসেন নেপু ঠাকুরকে। এরাই ছিলেন প্রবাসী সরকারের ৯ সদস্য বিশিষ্ট অনুমোদিত কমিটি।

মধু মিয়ার লেখাপড়া পাঠশালা পর্যন্ত হলেও তিনি ডায়েরিতে লিখে রাখতেন শহীদদের নাম এবং কোথায় কোন যুদ্ধে তারা শহীদ হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে কাউকে দিয়ে এ তথ্যগুলো লিখিয়ে রেখেছেন। আর এটাই হয়েছে আজ ইতিহাস।

মধু মিয়ার ডায়েরি থেকে জানা যায়, ৪২ জন মুসলিম শহীদকে দাফন করা হয়েছে এবং ৬ জন হিন্দু মুক্তিযোদ্ধাকে ডলুরাতে দাহ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে যেমন সুনামগঞ্জ জেলার মুক্তিযোদ্ধা আছেন ঠিক তেমনি অন্যান্য জেলার মুক্তিযোদ্ধাও আছেন। ডলুরায় যে সকল শহিদ মুক্তিযোদ্ধারা শায়িত আছেন তারা হলেন মন্তাজ মিয়া,রহিম বকস,জবান আলী,সুরুজ মিয়া,হরকুম উল্ল্যাহ,জয়নাল আবেদীন,মহরম আলী,আব্দুর রহমান,আব্দুছ ছাত্তার,আজমান আলী,আবেদ আলী,আতাহার আলী,লাল মিয়া,চান্দ মিয়া,সিদ্দিক মিয়া,আবু বকর সিদ্দিক,সায়েদুর রহমান,আব্দুল হামিদ খান,আব্দুল খালেক,যোগেন্দ্র দাস,শ্রীকান্ত দাস,অরবিন্দ রায়,কুবীন্দ্রনাথ দাস,সালাউদ্দিন,তাহের মিয়া,আব্দুল হক,মুজিবুর রহমান,নূরুল হক,আব্দুল করিম,সুরুজ মিয়া,সাজু মিয়া,ধনুমিয়া,ফজলুল হক,শামছুল ইসলাম,কেন্তু মিয়া,সিরাজ মিয়া,সমছু মিয়া,তারা মিয়া,দানু মিয়া,মন্নাফ মিয়া,রহিম মিয়া,আলী আহমদ। মধু মিয়ার এই ডায়েরিটি স্থান পেয়েছে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।

স্বাধীনতার পর দেশের শহীদ মুত্তিযোদ্ধাদের কবরকে সংরক্ষিত করার জন্য প্রশাসনসহ রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ধরনা দিযেছেন মধু মিয়া। কোনো লাভ হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত মুক্তি সংগ্রাম স্মৃতি ট্রাস্ট শহীদদের কবরগুলো সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেয়। ৮২ ফুট লম্বা, ৮১ ফুট প্রস্থ ও ৫ ফুট উচ্চতার এই দেয়াল তৈরি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের আরেক বীর সেনানী সাব সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব) এ,এস, হেলালউদ্দিন শহীদদের নাম মার্বেল পাথরে খোদাই করে লিখে গেইটে বসিয়ে দেন এবং শহীদদের আত্মীয় স্বজনদের রাত্রি যাপনের জন্য গেস্ট হাউজ নির্মাণের জন্য অনুদান দেন।

২০০৪ সালের ১৫ মার্চ মধু মিয়া মারা যাওয়ার পর ডলুরা শহীদ স্মুতিসৌধের ভেতরেই তাকে দাফন করা হয়। ৪২ জন শহীদ এবং তিনি এক সাথে ঘুমিয়ে আছেন।বর্তমানে জেলা প্রশাসন,জেলা পরিষদ,উপজেলা পরিষদের সার্বিক সহযোগিতায় কবর পাকা করণ ও সৌন্দর্য্য বর্ধণ,স্মৃতি ফলক নির্মাণ, মূল ফটকে স্থায়ী তোড়ন নির্মাণ, বিদ্যুতিক লাইট পোষ্টের বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করা,সমাধীর পাশের মাঠে পাশে মুক্তমঞ্চ নির্মাণ,মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর্য্য নির্মাণ, বসার জন্য ছাউনী নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে।

ডলুরা শহীদ মিনারকে ঘিরে রাস্তা ঘাটের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হওয়ায় মানুষ সহজেই কবর জিয়ারত করতে পারছেন এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের কারণে বেড়েছে দর্শনার্থীর ভিড়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মধুমিয়ার আত্মত্যাগের কথা নতুন প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় করে রাখতে সুনামগঞ্জের মঙ্গলকাটা বাজার থেকে ডলুরা শহীদ মিনার পর্যন্ত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা মধুমিয়া সড়ক’র নাম করণের দাবি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।

এ বিভাগের আরো খবর