প্রায় দেড় যুগ ধরে কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের হাতে তৈরি টুপি যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। বাহারি রঙের সুতা আর রেশম দিয়ে তৈরি এ টুপির চাহিদা বেড়ে চলছে।
ধর্মীয় অনুষঙ্গটি তৈরি করে সচ্ছল হয়েছেন কুড়িগ্রামের হাজারো নারী, যাদের এমন দিনবদলের রূপকার জেলার উলিপুর উপজেলার পাতিলাপুর গ্রামের মোর্শেদা বেগম।
এ উদ্যোক্তা ‘নিপুণ হস্ত শিল্প সম্ভার’ নামে টুপি তৈরির প্রতিষ্ঠানের পরিচালক।
শুরুটা যেভাবে
দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয় উল্লেখ করে মোর্শেদা বেগম জানান, বিয়ের পর ১৯৯৫ সালে জীবিকার সন্ধানে স্বামী জাবেদ আলীর সঙ্গে চলে যান টাঙ্গাইলে। সেখানে একটি তোয়ালে তৈরির কারখানায় কাজ নেন।
তিনি জানান, টাঙ্গাইলে ভাড়া যে বাসায় থাকতেন, সেখানকার প্রতিবেশী কমলা বেগমের কাছ থেকে টুপি তৈরির কাজ রপ্ত করেন। তখন থেকে দিনে কারখানার কাজ আর রাতে টুপি বানানো শুরু করেন। প্রথম টুপি তৈরি করে মজুরি পেতেন ৩৫০ টাকা। পরে তার নিখুঁত কাজ দেখে মুগ্ধ হন এক বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা।
ওই কর্মকর্তার জন্য ৫০টি টুপি বানিয়ে ১৭ হাজার টাকা পাওয়ার কথা জানিয়ে মোর্শেদা বলেন, ২০০৪ সালে উলিপুরের পাতিলাপুরে নিজ গ্রামে ফিরে স্থানীয় সাত নারীকে নিয়ে শুরু করেন টুপি তৈরি।
কুড়িগ্রামের টুপির মধ্যপ্রাচ্য যাত্রা
মোর্শেদা বেগম জানান, হাতে বানানো টুপি ২০০৮ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি হচ্ছে। তার সফলতার গল্প শুনে দলে দলে অন্য নারীরা টুপি বানানোর কাজে ছুটে আসেন। বর্তমানে তার সঙ্গে প্রায় পাঁচ হাজার নারী কাজ করছেন।
তার ভাষ্য, টুপি তৈরি করে পাতিলাপুরের আশপাশের ৪০টির বেশি গ্রামের নারীদের কর্মসংস্থান হয়েছে। নারীদের পাশাপাশি এ কাজে যুক্ত হয়েছেন পুরুষরাও।
কুড়িগ্রামের এ উদ্যোক্তা জানান, ফেনীর দুজন ব্যবসায়ীর কাছে তিনি তৈরি করা টুপি বিক্রি করেন, যেগুলো মধ্যপ্রাচ্যের বাহরাইন, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্রি হয়।
ওই ব্যবসায়ীরা রেশম সরবরাহ করেন জানিয়ে মোর্শেদা বলেন, তিনি নারীদের সঙ্গে নিয়ে স্রেফ সুঁই, সুতা দিয়ে তৈরি করেন নানা ধরনের নকশাখচিত টুপি।
মাসে আট থেকে ১০ হাজার টুপি
টুপি তৈরির দেখভাল করতে বিভিন্ন গ্রামে বেতনভুক্ত প্রায় ১৫ জন সুপারভাইজার রাখার কথা জানিয়ে মোর্শেদা বলেন, প্রতিটি টুপি তৈরির জন্য নারীরা পারিশ্রমিক পান ৮০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা। একটি টুপি বানাতে সুই সুতার গড় খরচ ১৫০ টাকা।
‘নিপুণ হস্ত শিল্প সম্ভার’ নামের কারখানার প্রতিষ্ঠাতা জানান, প্রতি টুপিতে তিনি কমিশন পান ৭০ থেকে ৯০ টাকা। প্রত্যেক মাসে বিক্রি করেন আট থেকে ১০ হাজার টুপি। এ সংখ্যা আরও বাড়ানো যাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে।
সচ্ছলতার সহায়
পাতিলাপুর গ্রামের হাওয়া বেগম জানান, চার বছর আগে মোর্শেদা বেগমের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে টুপি তৈরির কাজ শুরু করেন। এখন তার আর অভাব নেই। সংসারের রোজকার কাজের পাশাপাশি টুপি তৈরি করে ভালো আয় করছেন তিনি।
স্কুলপড়ুয়া ছাত্রীরাও যুক্ত হয়েছে টুপি তৈরির কাজে।
‘পড়াশোনার পাশাপাশি আমি মোর্শেদা আন্টির টুপি তৈরির কাজ করি। এখান থেকে যা উপার্জন করি, লেখাপড়ার খরচ মিটিয়ে বাবাকে সহযোগিতা করতে পারি। শুধু আমি না, আমার মতো বিভিন্ন বয়সের নারীরা এখানে কাজ করে ভালো টাকা পাচ্ছেন’, বলছিল অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মুক্তা খাতুন।
উলিপুরের সাত দরগাহ গ্রামের মৌসুমি বলেন, ‘সারা বছর আমরা টুপি তৈরির কাজ করি। বিশেষ করে রমজান মাস ও কোরবানি ঈদের সময় টুপির চাহিদা বেশি থাকে।
‘এ সময় টুপি বানিয়ে জনপ্রতি আট থেকে ১০ হাজার টাকা পাই। কয়েক বছর ধরে পরিবার নিয়ে খুব সুন্দর ঈদ কাটাতে পারছি।’
সহায়তার আশ্বাস বিসিকের
মোর্শেদা বেগমের উদ্যোগে কুড়িগ্রামের টুপির মধ্যপ্রাচ্য যাত্রাকে ‘ভালো খবর’ হিসেবে আখ্যা দেন জেলা বিসিকের উপব্যবস্থাপক শাহ মোহাম্মদ জোনায়েদ।
তিনি বলেন, ‘পাতিলাপুর গ্রামের নারী উদ্যোক্তা মোর্শেদা বেগমের টুপি মধ্যপ্রাচ্য যাচ্ছে। এটি কুড়িগ্রাম জেলার জন্য ভালো খবর। হাজার হাজার নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন তিনি।
‘সরকারি কোনো প্রশিক্ষণ, আর্থিক ঋণ অথবা তৈরি টুপির বাজারজাতকরণে কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হলে কুড়িগ্রাম বিসিক মোর্শেদা বেগমকে সহযোগিতা করবে।’