চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগরে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজে লাগা আগুন নিভেছে। তবে গুদামের ভেতরে ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে আগুন দেখা যাচ্ছে।
চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক বৃহস্পতিবার বিকেলে বলেন, ‘৮০ শতাংশ আগুন নিভিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছি। ২০ শতাংশ আগুন নেভানো যায়নি। মাঝে মাঝে টিনের ফাঁকে কিংবা মালামালের ফাঁকে একটু করে দেখা যাচ্ছে। সেটা আমরা দ্রুত পানি ছিটিয়ে নিভিয়ে ফেলছি। রাতের মধ্যেই আগুন পুরোপুরি নেভানোর টার্গেট আছে আমাদের। এখন মূলত আগুন নেভানোর চেয়েও ডাম্পিং কাজ বেশি করতে হচ্ছে।’
‘গুদামে থাকা চিনির ২০ শতাংশ নষ্ট হয়েছে’
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘এস আলমের বক্তব্য অনুযায়ী, গুদামে রাখা র-সুগারের উপরের লেয়ারটা অর্থাৎ মোট মালামালের ২০ শতাংশের মতো নষ্ট হয়েছে। বাকি মালামাল ঠিক আছে। আগুন পুরোপুরি নেভার পর বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মতামতের ভিত্তিতে এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আগুনের ঘটনায় আমরা তদন্ত কমিটি করেছি। কমিটি কাজ শুরু করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে বলতে পারব, কী কারণে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।’
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বৃহস্পতিবার আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানা পরিদর্শন করেন। ছবি: নিউজবাংলা
জেলা প্রশাসক বলেন, চিনিকলের গোডাউনের পোড়া বর্জ্য নদীতে ফেলতে নিষেধ করেছি।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছি। চিনির দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ইতোমধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে এসেছে।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ‘গুদামে এক লাখ টন চিনির কাঁচামাল মজুত ছিল। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর ১৮টি ইউনিটের প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হওয়ার কারণ হলো, যে কাঁচামালগুলো ছিল সেগুলো দাহ্য। পানি দেয়ার পরও সেগুলো আবার জ্বলে ওঠে।
‘তবে কিছু কিছু জায়গায় এখনো হালকা আগুন দেখা যাচ্ছে। রাতের মধ্যেই আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হবে।’
‘কর্ণফুলীর পানিতে এসিড’
পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, অগ্নিনির্বাপনের পানি সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে র-সুগার মিক্স আছে। সেটা আবার আগুনে গলে লাভায় পরিণত হয়েছে। সেই পানিটা নদীতে পড়ার কারণে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। অক্সিজেনের অভাবে জলজ প্রাণী ভেসে উঠছে।’
বৃহস্পতিবার সুগার মিল পরিদর্শনে এসে ফেরদৌস আনোয়ার এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি টেকনিক্যাল টিম সুগার মিল এলাকায় এসে কর্ণফুলী নদীর পানির নমুনা সংগ্রহ করেছে। আপাতত একটি উপাদানের পরীক্ষা শেষ করতে পেরেছি। পরীক্ষায় দেখতে পেয়েছি পানিতে এসিড রয়েছে। পানির যে স্ট্যান্ডার্ড মান তার চেয়ে নিচের দিকে রয়েছে। এ অবস্থায় জলজ প্রাণীদের বেঁচে থাকা কঠিন।
‘সব পরীক্ষা শেষ হতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে। ফাইনাল রিপোর্ট হাতে পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি তদন্ত কমিটিকে এ রিপোর্ট দেয়া হবে।’
দেশের সুগার মিলে সবচেয়ে বড় এই অগ্নিকাণ্ডের কারণ তদন্তে ইতোমধ্যে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। এটি নাশকতার ঘটনা কি না তা-ও খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছে কল-কারখানা অধিদফতর।
কারখানায় শনিবার উৎপাদন শুরুর আশা
এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলের চিনির গুদামের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসায় শনিবার থেকে কারখানায় চিনি পরিশোধন শুরু করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বৃহস্পতিবার বিকেলে এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তারা বলেন, ‘আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ৪ মার্চ বিকেলে সৃষ্ট ভয়াবহ এই আগুন সরকারের উচ্চ মহল, ফায়ার সার্ভিস, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ মিলের কর্মচারী ও প্রশাসনের সার্বিক প্রচেষ্টায় প্রায় ৬৪ ঘণ্টা পর পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়েছে। আমরা আশা করছি শনিবার (৯ মার্চ) থেকে আবারও চিনি উৎপাদন ও সরবরাহ শুরু করা যাবে। সে লক্ষ্যে মিল পরিষ্কারের কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে।’
প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, আগুনে এক লাখ টনের মতো অপরিশোধিত চিনি পুড়ে গেছে। সৌভাগ্যবশত আশপাশেই অবস্থিত অন্য ৩-৪টি গুদাম আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
আগামী ১০-১২ দিন সরবরাহ করার মতো পরিশোধিত চিনি প্রস্তুত রয়েছে। ইতোমধ্যে শনিবার পুনরায় চিনি পরিশোধন কার্যক্রম শুরু হলে তা বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে।
এস. আলম গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক আখতার হাসান বলেন, ‘ইতোমধ্যে কারখানায় পরিশোধিত চিনির মজুত থেকে বাজারে সরবরাহ শুরু হয়েছে। আগামী শনিবার মূল কারখানায় উৎপাদন শুরু করা হবে। সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে এই অগ্নি-দুর্যোগের কোনো প্রভাব যেন বাজারে না পড়ে।’
তিনি জানান, পুড়ে যাওয়া গুদামটিতে এক লাখ টনের বেশি অপরিশোধিত চিনি ছিল। বাকি গুদামগুলোতে ৬ লাখ ৪১ হাজার টন চিনির কাঁচামাল রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির দাবি, মিলে প্রয়োজন মোতাবেক সব ধরনের ফায়ার ইকুইপমেন্ট ও অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা ছিল। তবে আগুনের ভয়াবহতা বেশি হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
প্রসঙ্গত, সোমবার বিকেল ৩টা ৫৩ মিনিটের দিকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানাধীন ইছানগর এলাকার এস আলম সুগার রিফাইন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের গুদামে আগুন লাগে। ৬৪ ঘণ্টার টানা চেষ্টায় অবশেষে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।