আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালির মুখের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ৭০ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ বুধবার।
১৯৫২ সালে পাকিস্তানি হানাদার গোষ্ঠী যখন বাংলা ভাষা বাদ দিয়ে উর্দুকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে উঠেপড়ে লেগেছিল তখনই গর্জে ওঠে এদেশের ছাত্র ও তরুণ সমাজ। বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তারা।
তারই ধারাবাহিকতায় অনেক দেরিতে হলেও স্মরণীয় দিনটি মর্যাদা পায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। জাতীয়ভাবে দিনটি পালিত হয় মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
বাঙালি ছাড়া পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো জাতিকে ভাষার মর্যাদা রক্ষায় এভাবে প্রাণ দিতে হয়নি। প্রাণ এবং রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় মায়ের ভাষা বাংলা। তাই তো দিনটি যেমন গৌরবের, অহংকারের, তেমনই শোকেরও।
রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতি একুশের মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে।
রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে একুশের কর্মসূচি শুরু হবে। এছাড়াও কালো ব্যাজ ধারণ, প্রভাতফেরি সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা জানানো হবে।
শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কয়েক বছর ধরে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
দিনটি বাঙালি জাতির জন্য শোক ও বেদনার। অনদিকে মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত।
যে কোনো জাতির জন্য সবচেয়ে মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার হচ্ছে মৃত্যুর উত্তরাধিকার- মরতে জানা ও মরতে পারার উত্তরাধিকার। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদরা জাতিকে সে মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার দিয়ে গেছেন।
১৯৫২ সালের এই দিনে ‘বাংলাকে’ রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসক গোষ্ঠীর চোখ-রাঙানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে। মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুর্বার গতি পাকিস্তানি শাসকদের শঙ্কিত করে তোলে। সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক শহীদ হন।
ভাষা শহীদদের এই আত্মদান নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সরদার ফজলুল করিম ‘বায়ান্ন ও আগে’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বরকত, সালামকে আমরা ভালবাসি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা বরকত, সালাম আমাদের ভালবাসে। ওরা আমাদের ভালবাসে বলেই ওদের জীবন দিয়ে আমাদের জীবন রক্ষা করেছে। ওরা আমাদের জীবনে অমৃতরসের স্পর্শ দিয়ে গেছে। সে রসে আমরা জনে জনে, প্রতিজনে এবং সমগ্রজনে সিক্ত।’
এদের আত্মদানের মধ্যদিয়ে আমরা অমরতা পেয়েছি উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘আজ আমরা বলতে পারি দস্যুকে, বর্বরকে এবং দাম্ভিককে: তোমরা আর আমাদের মারতে পারবে না। কেননা বরকত সালাম রক্তের সমুদ্র মন্থন করে আমাদের জীবনে অমরতার স্পর্শ দিয়ে গেছেন।’
বরেণ্য শিক্ষাবিদ আবুল ফজল একুশ নিয়ে তার এক লেখায় লিখেছেন, ‘মাতৃভাষার দাবি স্বভাবের দাবি। ন্যায়ের দাবি, সত্যের দাবি- এই দাবির লড়াইয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদরা প্রাণ দিয়েছেন। প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন- স্বভাবের ব্যাপারে, ন্যায় ও সত্যের ব্যাপারে কোনো আপোষ চলে না, চলে না কোনো গোঁজামিল। জীবন-মৃত্যুর ভ্রূকুটি উপেক্ষা করেই হতে হয় তার সম্মুখীন।’
একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে এদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সঠিক নিয়মে, সঠিক রং ও মাপে নির্মিত জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে।
দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলো নিয়েছে নানা কর্মসূচি। আজিমপুর কবরস্থানে ফাতেহা পাঠ ও কোরআনখানির আয়োজনসহ দেশের সব ধর্মের উপাসনালয়ে ভাষা শহীদদের রূহের মাগফিরাত কামনায় প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানসহ সবাই অতীত ঐতিহ্য বজায় রেখে যাতে শহিদ মিনারে উপস্থিত হয়ে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারেন সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং দিবসটি পালনে নিয়োজিত সব প্রতিষ্ঠান ও সংলগ্ন এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারকরণে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
একুশের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার এবং ভাষা শহিদদের সঠিক নাম উচ্চারণ, শহিদ দিবসের ভাবগাম্ভীর্য রক্ষা, শহীদ মিনারের মর্যাদা সমুন্নত রাখা, সুশৃঙ্খলভাবে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, ইত্যাদি জনসচেতনতামূলক বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমগুলো অনুষ্ঠান প্রচার করছে। সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করছে বিশেষ ক্রোড়পত্র।