পঞ্চগড় জেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ৫১টি ইটভাটা, যার মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই কার্যক্রম চালাচ্ছে ৪১টি।
জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলায় সর্বোচ্চ ২২টি ইটভাটা আছে, যার মধ্যে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেয়েছে ১০টি।
এসব ইটভাটার জন্য প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ এক্সক্যাভেটর (ভেকু) দিয়ে কাটা হচ্ছে কৃষিজমির উপরিভাগ। এসব মাটি দুই শতাধিক ট্রাক্টর এবং ১০টির বেশি ড্রাম ট্রাকে করে নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন ইটের ভাটায়। প্রতিনিয়ত মাটি কাটার ফলে নষ্ট হচ্ছে ওই এলাকার কৃষিজমি; ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ।
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ১৫টি ইটভাটা রয়েছে দেবীগঞ্জ উপজেলার দন্ডপাল ইউনিয়নে। বাকিগুলো সুন্দরদিঘী, পামুলী, শালডাঙ্গা ও চেংঠি হাজরাডাঙ্গা ইউনিয়নে।
এ বছর ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করে ৪টি ইটভাটাকে জরিমানা ও দুটির নামে মামলা করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট শাখা আরও একটি ইটভাটার মালিককে দেড় লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করে।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, প্রায় ২৪ বছর ধরে মাটি কাটা হচ্ছে, তবে আগে ইটভাটার সংখ্যা কম ছিল। এখন ইটভাটা বাড়ায় মাটির চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। নগদ টাকার প্রয়োজনে জমির মালিকরা কৃষিজমির মাটি বিক্রি করছেন। তিন ফুট গভীরতার এক বিঘা জমির মাটি ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়।
তারা জানান, এরই মধ্যে দন্ডপাল ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিচু জমিতে পরিণত হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় এখানকার কয়েকটি গ্রাম অপরিকল্পিত খালে পরিণত হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) পঞ্চগড় আঞ্চলিক শাখার সাধারণ সম্পাদক আজহারুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ‘পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। তিন ফসলি জমি নষ্ট করে সেখান থেকে মাটি কেটে ইটভাটার জন্য ব্যবহার কোনোক্রমেই আইনসিদ্ধ নয়। ইটভাটা স্থাপন ও নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, এভাবে কৃষিজমির মাটি কাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও এ ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ হয় না।
‘সচেতন মহলের কেউ কেউ এ বিষয়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অবহিত করলেও নেয়া হয় না কোনো ব্যবস্থা। এতে করে মাটি কাটায় জড়িতরা আইনকে বৃদ্ধাঙুলি দেখাচ্ছে। আমরা অবিলম্বে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
শ্রমিক সংগঠনের নেতা রবিউল ইসলাম জানান, দন্ডপাল ইউনিয়নে প্রায় ২২টি ভেকু, ২০০টি ট্রাক্টর এবং ১৫টি ড্রাম ট্রাক প্রতিদিন মাটি সরবরাহ করে। ইটভাটাগুলোতে মালিকদের চাহিদামতো তিনি মাটি সরবরাহ করেন।
এই কাজে বৈধতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে ইটভাটার মালিকদের সঙ্গে কথা বলেন আপনারা।’
উপজেলার ইটভাটা সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘মাটি কাটার কারণে জমির তেমন ক্ষতি হয় না। সরকার আমাদের ব্যবসার স্বার্থে মাটি কাটার বিকল্প ব্যবস্থা না করলে আমরা কী করব? আমরা তো গণমাধ্যমকর্মী, পরিবেশ অধিদপ্তর, উপজেলা-জেলা প্রশাসনসহ সবাইকে ম্যানেজ করেই চলছি।’
উপজেলার দন্ডপাল ইউনিয়নের ধনমন্ডল গ্রামের ইউনুছ আলী জানান, তার জমির চারপাশের মাটি বিক্রি হয়ে গেছে। তার প্লটটি চাষের অনুপযোগী হয়ে গেছে। এ কারণে বাধ্য হয়েই ভাটায় জমির মাটি বিক্রি করেছেন।
দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শরীফুল আলম বলেন, ‘জমির টপ সয়েল কাটা আইনত অপরাধ। ভূমির মালিকসহ যারা এই কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সকল ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর পঞ্চগড়ের সহকারী পরিচালক ইউসুফ আলী সংস্থাটিকে ম্যানেজ করে ইটভাটা চালানো ও উপরিভাগের মাটি কেটে নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
তিনি বলেন, ‘জেলায় ৫১টি ইটভাটার মধ্যে ১০টি ইটভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে, বাকিগুলো অবৈধ। এ বছর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে চারটি ইটভাটার মালিককে জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া দুইটি ইটভাটার মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তিনটি ভাটার বিরুদ্ধে অভিযোগ অধিদপ্তরে পাঠানো হয়।
‘এর মধ্যে নিষিদ্ধ এলাকায় ইটভাটা স্থাপনের মাধ্যমে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতিসাধন করায় একটি ইটভাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট শাখা দেড় লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করেছে।’