অমর একুশে বইমেলায় যে শুধু বই বিক্রি হয় তা নয়, এখানে চলছে সেবামূলক নানা কার্যক্রম। প্রকাশনী খুঁজে বের করা থেকে শুরু করে, রক্তদান কর্মসূচি, শারীরিক প্রতিবন্ধীদের বিনামূল্যে হুইল চেয়ার সেবা দেয়াসহ ব্রেস্ট ফিডিং সেন্টারও করা হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা থেকে বইমেলায় সেবামূলক এসব কার্যক্রম চলছে।
মেলা ঘুরে দেখা যায়, বইমেলার স্থানে স্থানে চলছে সেবামূলক কার্যক্রম। স্বেচ্ছাসেবক, পুলিশ আনসারসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা এসব কার্যক্রমে সহযোগিতা করছেন। মেলার ভেতর এমনকি বাইরেও এসব কার্যক্রম চলছে।
বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা
মেলা প্রাঙ্গণে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করেছে ঢাকা ওয়াসা। প্রায় প্রতিটি প্রবেশদ্বারের পাশেই রয়েছে পানির বুথ। এতে স্বস্তি ও সন্তোষ প্রকাশ করছেন মেলায় আগতরা।
বাংলা একাডেমির প্রবেশপথে ঢুকেই লিমন সোজা চলে এলেন পানির ফিল্টারের কাছে। পানিপান শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিচ্ছেন। লিমন বললেন, ‘অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছিলাম। শুনেছি ফুড কোর্ট সোহরাওয়ার্দীর অনেক ভেতরে। কিন্তু বেশ তৃষ্ণা পাচ্ছিল। একজন বলল এখানে ঢুকে একটু এগুলেই পানি পাওয়া যাবে। এসে দেখলাম লেখা- বিনামূল্যে পানির ব্যবস্থা।’
স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি
‘রক্তে মোরা বাঁধন গড়ি, রক্ত দেবো জীবন ভরি’ স্লোগানে বইমেলায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি চলছে। প্রতিবছরের মতো এবারও মেলার শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত চলবে এই কার্যক্রম।
বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে প্রবেশ গেট দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকে তাকালেই চোখে পড়বে ডিএমপির স্বেচ্ছায় রক্তদান কেন্দ্রটি। এ কর্মসূচির আওতায় শুধু রক্ত গ্রহণই নয়, এখানে সংগৃহীত রক্ত বিভিন্ন মুমূর্ষু রোগীর প্রয়োজনে পৌঁছে দেয়া হয়। তাছাড়া যাদের রক্তের প্রয়োজন তারাও এখানে এসে বিনামূল্যে রক্ত নিয়ে যেতে পারেন।
বইমেলায় আগতদের মধ্য থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে আসেন। তবে বন্ধের দিনগুলোতে রক্তদাতার সংখ্যা থাকে শতাধিক। এছাড়াও স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম ‘কোয়ান্টাম’ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সন্ধানী’-এর উদ্যোগেও বইমেলায় স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি চলছে।
হুইল চেয়ার
শারীরিক প্রতিবন্ধী ও হেঁটে চলাফেরায় অক্ষমদের বিনামূল্যে হুইল চেয়ারে মেলা ঘুরে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে ‘সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন। প্রতিদিন মেলার টিএসসির সামনে কমপক্ষে ২০টি হুইল চেয়ারে ২০ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। প্রতিবন্ধী কিংবা চলাফেরা করতে অক্ষম যে কেউ বিনামূল্যে সেবাটি নিতে পারছেন।
বাংলা একাডেমি ও বিকাশের সহযোগিতায় তারা এ সেবাটি দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত পঞ্চাশেরও বেশি মানুষকে তারা এ সেবা দিয়েছেন। স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে আনন্দ ও মানসিক শান্তি পাচ্ছেন বলে জানান স্বেচ্ছাসেবীরা।
তাদের একজন ঢাকা কলেজের স্নাতক পড়ুয়া শিক্ষার্থী আল আমিন বলেন, ‘২০১৬ সাল থেকে মেলায় ঘুরতে আসা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের আমরা সেবা দিয়ে আসছি। তাদের মেলা ঘুরিয়ে দেখাতে পারার মাঝে একটা আনন্দ আছে।’
ব্রেস্ট ফিডিং সেন্টার
বইমেলায় আগত যেসব মায়ের কোলে ছোট্ট শিশু থাকে তাদের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উদ্যোগে ‘ব্রেস্ট ফিডিং সেন্টার’ চালু করা হয়েছে। এ বছর প্রথমবারের মতো ডিএমপির এই অনন্য সেবা। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুলিশ কন্ট্রোল রুমের দক্ষিণ পাশেই এ সেন্টারটি অবস্থিত।
প্রতিদিন শতাধিক মা তার শিশুকে বুকের দুধ পান করাতে ডিএমপির ব্রেস্ট ফিডিং সেন্টারে আসছেন। ব্রেস্ট ফিডিং সেন্টারে আসা মা ও তাদের সাথে থাকা ছোট্ট সোনামনিদের সহযোগিতায় সেখানে ডিএমপির নারী পুলিশ সদস্যরা কর্মরত রয়েছেন।
মিরপুর থেকে আগত এক মা অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, ‘ব্রস্ট ফিডিং সেন্টারের এই উদ্যোগে পুলিশের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেলো। আমরা মায়েরা এখন কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই কোলের ছোট্ট শিশুকে নিয়েও মেলায় ঘুরতে পারছি। তা না হলে আমরা মায়েরা এমন একটি প্রাণের মেলায় আসার সাহসই পেতাম না।’
বাংলা একাডেমির কন্ট্রোল রুম
এবারের বইমেলায় বাংলা একাডেমির বেশ কয়েকটি কন্ট্রোল রুম রয়েছে। এসব কন্ট্রোল রুম থেকে আগতরা বিভিন্ন প্রকাশনীর ঠিকানা জানতে পারছেন।
এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমির ডেপুটি ডিরেক্টর ফারহানা খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলা একাডেমির ভেতরে ও বইমেলা প্রাঙ্গণে আমাদের বেশ কয়েকটি কন্ট্রোল রুম রয়েছে। আমরা প্রধান কন্ট্রোল রুম থেকে মাইকে বইপ্রেমীদের নতুন বই প্রকাশের বিষয়ে জানান দিয়ে থাকি। এছাড়াও মানবিক আবেদন যেমন রক্তদানসহ দরিদ্র রোগীদের সাহায্যের জন্য সবার কাছে সাহায্যের আবেদন জানানো হয়।
‘মেলায় ঘুরতে এসে কেউ প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেললে কিংবা কারও মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ ইত্যাদি হারিয়ে গেলে আমরা তা কন্ট্রোল রুম থেকে ঘোষণা দিয়ে থাকি।
সহযোগিতায় বিকাশ
বাংলা একাডেমির আয়োজিত অমর একুশে বইমেলার একমাত্র স্পন্সর মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ‘বিকাশ’। বিকাশের উদ্যোগে মেলায় আগতদের জন্য বেঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত অনেকেই সেখানে বিশ্রাম নিতে পারছেন।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য মেলায় বই ডোনেশন ক্যাম্পেইনও করছে বিকাশ। এই উদ্যোগের মাধ্যমে মেলায় আসা পাঠকদের কাছ থেকে স্বল্প মূল্যে বই সংগ্রহ করা হয়। বিকাশ মেলা থেকে যত বই পাবে সেগুলো তাদের পরিচালিত স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করবে।
এছাড়াও মেলায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের একটি কন্ট্রোল রুম রয়েছে। তাদের টিমের সদস্যরা মেলার বিভিন্ন স্থানে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র নিয়ে টহল দিচ্ছেন। যেকোনো ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঠেকাতে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়িও সর্বদা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।
মেলায় বরাবরের মতোই রয়েছে পুলিশ, আনসার ও র্যাবের কন্ট্রোল রুম। এসব সংস্থার সদস্যরা মেলা জুড়ে দর্শনার্থীদের প্রতিনিয়ত বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহায়তা করছেন।
এদিকে বাংলা একাডেমির সার্বিক তত্ত্বাবধানে মেলায় আগতদের বিনামূল্যে রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও বইপ্রেমীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছে ঢাকা সিভিল সার্জন কার্যালয়। ওষুধ কিংবা চিকিৎসা নিয়ে তাদের সহায়তা করতে প্রতিনিয়ত এ স্টলে রয়েছেন একজন ডাক্তার ও ফার্মাসিস্ট। শনিবার পর্যন্ত মেলায় দুই শতাধিক মানুষকে তারা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন।
এছাড়াও ডেটলের উদ্যোগে মেলায় বিনামূল্যে সাবান দিয়ে হাত ধৌত করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মেলার বাইরে বিআরটিসির একটি বাসে ফ্রি বই পড়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
বইমেলার ১৭তম দিন শনিবার মেলা শুরু হয় সকাল ১১টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত মেলায় ছিল শিশুপ্রহর। এদিন নতুন বই এসেছে ১৭১টি।
সকাল ১০টায় বইমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। ক-শাখায় প্রথম হয়েছে নীলান্তী নীলাম্বরী তিতির, দ্বিতীয় হয়েছে রোদসী আদৃতা এবং তৃতীয় হয়েছে নৈঋতা ভৌমিক।
খ-শাখায় প্রথম তানজিম বিন তাজ প্রত্যয়, দ্বিতীয় সুরাইয়া আক্তার ও তৃতীয় হয়েছে রোদসী নূর সিদ্দিকী।
গ-শাখায় প্রথম কে. এম. মুনিফ ফারহান দীপ্ত, দ্বিতীয় নবজিৎ সাহা ও তৃতীয় হয়েছে সরকার একান্ত ঐতিহ্য।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘শহীদ সাবের এবং স্মরণ: পান্না কায়সার’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মনির ইউসুফ ও মামুন সিদ্দিকী। আলোচনায় অংশ নেন গিয়াস উদ্দিন, রতন সিদ্দিকী ও শমী কায়সার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রামেন্দু মজুমদার।
এদিন লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি শান্তা মারিয়া, কথাসাহিত্যিক এশরার লতিফ, শিশুসাহিত্যিক আহসান মালেক ও প্রাবন্ধিক সুমন শামস্।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি মিনার মনসুর, হাফিজ রশিদ খান ও আয়শা ঝর্না। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী গোলাম সারোয়ার এবং রফিকুল ইসলাম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুথি পাঠ করেন কাব্য কামরুল। এছাড়াও ছিল আবিদা রহমান সেতুর পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বহ্নিশিখা’ এবং মঙ্গল চন্দ্র মণ্ডলের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’-এর পরিবেশনা।
অমর একুশে বইমেলা আয়োজনের অংশ হিসেবে এদিন প্রথমবারের মতো সংযোজিত ‘বই-সংলাপ ও রিকশাচিত্র প্রদর্শন মঞ্চ’-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠান বিকাল ৫টায় মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের লেকসংলগ্ন মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়।
রোববারের সময়সূচি
রোববার মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। এদিন বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ: জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন স্বরোচিষ সরকার।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের লেকসংলগ্ন মঞ্চে প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে রিকশাচিত্র প্রদর্শনের পাশাপাশি মেলায় প্রকাশিত মানসম্পন্ন নির্বাচিত বই নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান চলবে।