সিলেটে বেড়েই চলেছে সবজিবাহী ট্রাক আটকে চাঁদাবাজির ঘটনা। সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে ট্রাক আটকে চাঁদা আদায় করছে একটি গোষ্ঠি। চাঁদা না পেলে ছিনিয়ে নিচ্ছে সবজি।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এই চাঁদাবাজির সঙ্গে স্থানীয় ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী জড়িত। এতে পুলিশেরও যোগসাজশ রয়েছে।
অবশ্য পুলিশ ও ছাত্রলীগ- উভয় পক্ষ থেকেই এমন অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
এমতাবস্থায় সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ ও নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন সিলেটের ব্যবসায়ী ও পরিবহন শ্রমিকরা।
চাঁদাবাজি ও ছিনতাই বন্ধের দাবিতে সিলেট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে গত বৃহস্পতিবার সবজি চাষি, কাঁচামাল ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী নেতা ও সবজি পরিবহনকারী শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন।
বিক্ষাভ থেকে সবজি ব্যবসায়ীরা জানান, সিলেটের কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলায় প্রচুর পরিমাণ শীতকালীন সবজি চাষ হয়। এসব সবজি প্রতিদিন ভোরে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা সিলেট নগরীর সোবহানীঘাট ও বন্দরবাজার পাইকারি আড়তে নিয়ে আসেন। ভোরে সবজি নিয়ে আসার সময় সিলেট-তামাবিল সড়কের হরিপুর, বটেশ্বর, মেজরটিলা, টিলাগড় ও সোবহানীঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজির শিকার হন তারা।
আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা চাঁদাবাজরা হঠাৎ করে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কার নিয়ে সড়কে ব্যারিকেড দেয়। এরপর গাড়ি আটকে চাঁদা দাবি করে তারা।
প্রতি গাড়ি থেকে তারা ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে জানিয়ে আরও বলা হয়, ‘টাকা না পেলে অনেক সময় চালককে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে গাড়ি ছিনতাই করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে পণ্য লুট করে নেয় তারা।’
ব্যবসায়ীদের দাবি, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ও তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনকে বিষয়টি অবগত করেন তারা। সড়কে পণ্যবাহী পরিবহনের নির্বিঘ্নে চলাচল নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে নির্দেশও দেন তিনি, কিন্তু এই নির্দেশের পরও থামেনি চাঁদাবাজি।
এরপর ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয় উল্লেখ করে তাদের দাবি, তারপরও বেপরোয়া চাঁদাবাজদের তৎপরতা থামেনি।
এ অবস্থায় ব্যবসায়ী ও পরিবহন শ্রমিকরা জোটবদ্ধ হয়ে বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। পরে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন তারা।
সে সময় সিলেট চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নেতারাও কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে সিলেটের সবজি ব্যবসায়ীদের বৃহস্পতিবারের বিক্ষোভ। ছবি: নিউজবাংলা
বিক্ষোভ থেকে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতারা এই চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত। সিলেট-তামাবিল সড়কের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ পরিচয় দিয়ে দুর্বৃত্তরা গাড়ি আটকে অস্ত্রের মুখে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে চাঁদা আদায় করছে। চাঁদা না পেলে তারা পণ্য লুট করে নিচ্ছে।
এমনকি শাহপরান থানার পুলিশ সদস্যদের সামনেই তারা সবজির গাড়ি আটকে প্রতি গাড়ি থেকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা আদায় করে বলে অভিযোগ করেন ওই ব্যবসায়ীরা।
সবজি ব্যবসায়ী আশিক মিয়া বলেন, ‘আমি জৈন্তা (জৈন্তাপুর), কানাইঘাট ও জাফলং এলাকা থেকে ফুলকপি, পাতাকপিসহ (বাঁধাকপি) বিভিন্ন কাঁচামাল নিয়ে আসি। শাহপরান এলাকা থেকে শিবগঞ্জ, মিরাবাজার, রায়নগর এলাকায় অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আমার এসব সবজি তারা (দুর্বৃত্তরা) নিয়ে যায়।
‘গত শুক্রবার রাত ১২টার দিকে তারা আমার ১ লাখ টাকার মালামাল নিয়ে গেছে। প্রতিদিন এই ধরনের ঘটনা ঘটে, কিন্তু পুলিশ কিছু করছে না।’
সিলেট-তামাবিল মহাসড়কে চাঁদাবাজির যন্ত্রণায় ব্যবসায়ীরা অতিষ্ঠ উল্লেখ করে সিলেট মহানগর ব্যবসায়ী ঐক্য কল্যাণ পরিষদের সভাপতি আবদুর রহমান রিপন বলেন, ‘স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রশাসনকে একাধিকবার বিষয়টি অবগত করলেও ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজি থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না।’
এ ব্যাপারে সিলেট চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাহমিন আহমদ বলেন, ‘রাতে গাড়ি থেকে সবজি ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির ড্রাইভার থেকে শুরু করে সবজি চাষিদেরকে মারধরও করছে।
‘এভাবে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করতে থাকলে এর প্রভাব আগামী রমজান মাসেও পড়বে। কারণ ছিনতাই কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে শহরে কেউ পণ্য নিয়ে আসবে না।’
তিনি বলেন, ‘রমজান মাসে যদি ভোক্তাদেরকে ঠিকমত পণ্য সরবরাহ করতে না পারি, তাহলে সবাই ক্ষতির সম্মুখীন হবে।’
তবে সড়কে চাঁদাবাজিতে ছাত্রলীগের সম্পৃক্তার অভিযোগ অস্বীকার করেন সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ।
তিনি বলেন, ‘চাঁদাবাজির সঙ্গে ছাত্রলীগের কেউ জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। দুর্বৃত্তরা ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করলে তার দায় ছাত্রলীগ নিতে পারে না।’
দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কঠোর হলে তাদের আসল পরিচয় বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
পুলিশের সামনে সবজি ছিনতাইয়ের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (গণমাধ্যম) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এরকম অভিযোগ আমাদের কাছে কেউ করেননি। এ ধরনের কোনো ঘটনা যদি ঘটে থাকে, আমরা খোঁজখবর নেব।
‘যেহেতু ভুক্তভোগীরা সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন, আমাদেরকেও এটা যাচাই করে দেখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘কোনো ধরনের বিচ্যুতি সহ্য করা হবে না। এটা অন্যায়। যেহেতু অবগত হয়েছি, অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ধরনের ঘটনা ঘটুক, তা আমরা চাই না।’