টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পকে সম্প্রতি ভারত তাদের নিজস্ব পণ্য দাবি করে জিআই স্বত্ব করে নিয়েছে। এ ঘটনায় ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্প-সংশ্লিষ্টরা। অতি দ্রুত ভারতের জিআই বাতিল করে টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে জিআই স্বত্ব করার দাবি জানিয়েছে জেলার তাঁত মালিক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন।
এদিকে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক কায়সারুল ইসলাম এ বিষয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। প্রায় দুশ’ বছর ধরে নিজস্ব ঐতিহ্য বহন করে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সুনাম কুড়িয়েছে এই হস্তশিল্প।
‘নদী চর খাল বিল গজারির বন, টাঙ্গাইল শাড়ি তার গর্বের ধন’- শত বছর ধরে এই স্লোগান বহন করে এলেও সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারত টাঙ্গাইল শাড়ি নিজেদের দাবি করে জিআই স্বত্ব নিয়ে নিয়েছে। এতে খোদ ভারতেরই সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর টাঙ্গাইলে তাঁত সংশ্লিষ্টসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যে অনেক সংগঠন প্রতিবাদ-মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে।
তাঁত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টাঙ্গাইল ৱবাংলাদেশের একটি জেলা এবং প্রায় দুশ’ বছর ধরে নিজস্ব ঐতিহ্য বহন করে সারা বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে। দেশের নাম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গর্বের সঙ্গে তুলে ধরেছে।
‘এটা কোনোভাবেই ভারতের পণ্য হিসেবে জিআই স্বত্ব পেতে পারে না। যদি ভারতের নিজস্ব পণ্য হতো তাহলে কেন টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ি নামকরণ হয়েছে? জানামতে, ভারতে টাঙ্গাইল জেলা নামে কোনো জেলা বা তাঁতসমৃদ্ধ অঞ্চলও নেই।
ভারতের ওই জিআই স্বত্ব দ্রুত বাতিল করে টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে জিআই স্বীকৃতির দাবি তাদের।
তাঁত শ্রমিক ধীরেন পাল বলেন, ‘বাপ-দাদার আমল থেকে তাঁতের শাড়ি বুনছি। আর এখন ভারত দাবি করবে আর তাদের হয়ে যাবে তা মানা যায় না। এটা কখনোই হতে দেয়া যাবে না।’
প্রভাব মণ্ডল নামে আরেক শ্রমিক বলেন, ‘ভারত দাবি করবে আর তাদের হয়ে যাবে তা হবে না। এই শাড়ির জন্ম ও শিল্পটার বেড়ে ওঠা টাঙ্গাইলের মাটিতে। তাই টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির জিআই স্বত্ব বাংলাদেশের নামেই হতে হবে।’
টাঙ্গাইলের পাথরাইল তাঁতপল্লীর তারাপদ শাড়ি ঘরের মালিক পলাশ বসাক বলেন, ‘আমাদের টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। এই শাড়ি কেউ দাবি করবে তা হবে না।’
যজ্ঞেশ্বর শাড়ি ঘরের মালিক খোকন বসাক বলেন, ‘এই টাঙ্গাইলের মাটিতে তাঁতে শাড়ি বুনন শুরু হয়েছে। যেটাকে আমরা জন্ম দিলাম সেটা তারা নিয়ে যাবে এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়ার বিষয় না। এটা কিভাবে ভারত তাদের পণ্য দাবি করে তা আমাদের বুঝে আসে না।’
এদিকে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি ভারতের জিআই ট্যাগ পাওয়ার প্রতিবাদে শনিবার টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছেন সচেতন নাগরিকরা।
মুইত হোসেন তড়িৎ নামে একজন বলেন, ‘আমাদের টাঙ্গাইলের শাড়ি আমাদের ঐতিহ্য। এটা কখনোই ভারত তাদের পণ্য বলে দাবি করতে পারে না। এটা জিআই হলে বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের পণ্য হিসেবে হবে, ভারতের নয়।’
টাঙ্গাইল শাড়ি মালিক সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, ‘আমরা এই জিআই কখনও মানব না। সরকারকে বলবো যে কোনো মূল্যে নিজেদের নামে টাঙ্গাইলের শাড়ির জিআই করতে। অন্যথায় টাঙ্গাইলের শাড়ি ব্যবসায়ীরা কঠোর আন্দোলনে যাবে।’
জেলা প্রশাসক কায়সারুল ইসলাম জানান, ভারত ২০২০ সালে জিআই আবেদন করে। আর টাঙ্গাইল শাড়ির ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে ২০১৭ সালে। এটি টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য। গত মঙ্গলবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এই তাঁত শাড়ি জিআই পণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে সভা অনুষ্ঠিত হয়। টাঙ্গাইল শাড়ি জিআই করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, দুশ’ বছরের ঐতিহ্য টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির স্বর্গরাজ্য সদর উপজেলার পোড়াবাড়ি, দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল ও কালিহাতীর বল্লা। এসব এলাকায় তাঁতসংশ্লিষ্ট প্রায় সাড়ে তিন লাখ মালিক-শ্রমিক রয়েছেন।