দেশের সর্বকনিষ্ঠ উপজেলা কর্ণফুলীতে গত সাত বছরে ৭ জন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বদলি হয়েছেন। এ ছাড়া আরও একজন ইউএনও পদায়িত হলেও কর্ণফুলীতে যোগদান না করেই তিনি অন্যত্র বদলি হয়েছেন। নতুন একটি উপজেলায় ঘন ঘন ইউএনওর বদলিতে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
কেননা ছোট উপজেলা হিসেবে খ্যাত কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায়ও এই সময়ের মধ্যে এত সংখ্যক ইউএনও বদলি হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। কর্ণফুলী উপজেলায় মাত্র পাঁচটি ইউনিয়ন। স্থানীয়দের ধারণা, এখানে বদলি হয়ে আসার পর রাজনৈতিক কোন্দল কিংবা জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতার কারণেই দ্রুত বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, কর্ণফুলী উপজেলার প্রথম ইউএনও হিসেবে যোগদান করেন মোহাম্মদ আহসান উদ্দিন মুরাদ। ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল তিনি পদায়িত হন। নিয়োগের মাত্র ৩ মাসের মাথায় তাকে বদলি করা হয়। বদলির ৮ দিন পর তা আবার স্থগিত করা হয়। ঠিক পরের দিন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় আবারও তাকে বদলি করে।
এরপর ২০১৭ সালের ৫ জুলাই মুরাদের স্থলাভিষিক্ত হন নতুন উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিজেন ব্যানার্জী, বর্তমানে যিনি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। তিনি বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ২৯তম ব্যাচের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। তিনিও ১ বছরের বেশি সময় থাকতে পারেননি এ উপজেলায়।
এরপর ২০১৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কর্ণফুলীতে তৃতীয় ইউএনও হিসেবে যোগদান করেন সৈয়দ শামসুল তাবরীজ। তিনি ছিলেন ৩০তম বিসিএসের কর্মকর্তা। বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (কুমিল্লার এডিএম) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মাত্র এক বছর ৪ মাস ৭ দিন পর বদলি হন তিনিও।
পরে সেখানে নতুন ইউএনও হিসেবে নিয়োগ পান ৩১তম বিসিএস (প্রশাসন) কর্মকর্তা প্রবীর কুমার রায়। তিনি কর্ণফুলী উপজেলার আদেশ বাতিল করে কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায় তাৎক্ষণিক বদলি নেন।
এর মধ্যে ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নতুন ইউএনও হিসেবে যোগদান করেন ২৯তম বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার মো. নোমান হোসেন। বর্তমানে পদোন্নতি পেয়ে তিনি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) হয়েছেন। তিনি কর্ণফুলীতে যোগদানের ৫ মাস যেতে না যেতেই ওই বছরের ১৬ জুলাই বদলি হয়ে যান। অবশ্য করোনা মহামারী চলাকালে তিনি কিছুদিন কর্ণফুলীতে কাজ করেছিলেন।
সেসময় একই আদেশে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে কর্ণফুলী উপজেলায় নতুন ইউএনও হিসেবে পদায়িত হন আরেক বিসিএস ক্যাডার শাহিনা সুলতানা। তিনি ছিলেন ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা। ৩০ জুলাই উপজেলায় যোগদান করে সবার রেকর্ড ভেঙ্গে তিনি ১ বছর ৮ মাস ২৮ দিন কর্ণফুলী উপজেলায় কর্মরত থেকে সুনাম কুড়িয়েছেন।
পরে ২০২২ সালের ১৩ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে তাকে উপজেলা থেকে সরিয়ে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) উপ-পরিচালক পদে পদায়ন করা হয়। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের ডিডিএলজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) ড. প্রকাশ কান্তি চৌধুরী স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে কর্ণফুলীর ইউএনও হিসেবে আবারও মো. মামুনুর রশীদকে নিয়ে আসা হয়। তিনি ৩৪তম বিসিএসের কর্মকর্তা ছিলেন। ২০২২ সালের ২ অক্টোবর যোগদান করে তিনি ১ বছর ২ মাস ১৩ দিন সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে ২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সম্মতিক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন-২ শাখার উপ-সচিব ভাস্কর দেবনাথ বাপ্পীর স্বাক্ষরিত এক আদেশে তাকে আবারও বদলি করা হয়।
পরে ১০ ডিসেম্বর কর্ণফুলী উপজেলার নতুন ইউএনও হিসেবে পদায়িত হন দীপংকর তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি ৩৩তম বিসিএস কর্মকর্তা। এর আগে তিনি কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ার ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তিনিও মাত্র ১ মাস ২১ দিন দায়িত্ব পালনের পর বুধবার (৩১ জানুয়ারি) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রেষণ-১ অধিশাখার উপ-সচিব আব্দুল্লাহ আরিফ মোহাম্মদ স্বাক্ষরিত এক আদেশে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বদলি হয়েছেন।
২০১৭ সালে থেকে ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এই স্বল্প সময়ে কর্ণফুলী থেকে মোট ৭ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বদলি কার্যকর হয়েছে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) এ উপজেলায় ইউএনও হিসেবে মাসুমা জান্নাতকে পদায়ন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ শামীম আলম নিউজবাংলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
এক উপজেলায় ৭ বছরে আটজন ইউএনওকে বদলি ও পদায়ন বিষয়ে জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারি চাকরির নিয়ম মোতাবেক বদলি, পদায়ন একটি স্বাভাবিক বিষয়। অনেক সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকেও উপজেলায় সরাসরি ইউএনও পদায়ন করা হয়। জ্যেষ্ঠদের পদোন্নতিজনিত কারণেও নতুনদের পদায়ন হয়।’
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৯ মে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) ১১২তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকার চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলাধীন চরলক্ষ্যা, চরপাথরঘাটা, শিকলবাহা, জুলধা ও বড়উঠান ইউনিয়ন সমন্বয়ে কর্ণফুলী থানাকে উপজেলায় উন্নীতকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২০১৭ সালের ২৯ এপ্রিল কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের আনুষ্ঠানিক ও দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হয়।