ময়মনসিংহে সবচেয়ে বেশি টমেটো চাষ হয় সদরে। প্রতি বছরই বিভিন্ন জাতের টমেটো আবাদ করে থাকেন উপজেলার চাষিরা, তবে এবার উপজেলায় চাষ হওয়া একটি জাত নিয়ে চলছে আলোচনা।
কৃষকরা বলছেন, এবার সদর উপজেলার বোরোরচরে ‘টেম্বো’ নামের টমেটোর একটি জাতের আবাদ করেছেন তারা, যা থেকে আগাম ও বেশি ফলন পাওয়া গেছে।
গুচ্ছগ্রামে গিয়ে যা জানা গেল
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোরোরচর ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রামে গিয়ে দেখা যায়, একেকটি গাছে পাকা-আধাপাকা অনেক টমেটো ঝুলে আছে। এগুলো তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক ও শ্রমিকরা। ক্ষেত থেকে তোলার সঙ্গে সঙ্গে ওজন দিয়ে কিনে নিচ্ছেন পাইকাররা।
ওই সময় কথা হয় কৃষক মোস্তাকিম মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময় অনেক জাতের টমেটো চাষ করেছি, তবে টেম্বোর মতো আগাম জাত পাওয়া যায়নি।
‘এ ছাড়া এই টমেটো পাকার পরেও শক্ত থাকায় সহজেই বাজারজাত করা যাচ্ছে। এ কারণে লাভও বেশি হচ্ছে। অন্য কৃষকরাও জাতটি পেয়ে অনেক খুশি।’
রাজিব মিয়া নামে আরেক কৃষক বলেন, “উচ্চ ফলনশীল ‘মঙ্গল’ নামের একটি টমেটোর জাত কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়, তবে এবারই প্রথম কৃষকদের মধ্যে আলোচনায় এসেছে টেম্বো। অন্য কৃষকদের দেখাদেখি আমিও চাষ করে ভালো ফলন পেয়ে আশানুরূপ লাভবান হয়েছি।”
কৃষক সারজুল ইসলাম বলেন, ‘একটি জমিতে যেকোনো জাতের টমেটোর ২০০টি চারা লাগানো গেলে টেম্বো জাতের ৪৫০টি চারা লাগানো যায়। এতে ফলনও অনেক বেশি পাওয়া যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন রোগ সহনশীল এই জাতটি নানা কারণে কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।’
যেভাবে দেশে টেম্বো
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফ্রান্সের টেকনিজম কোম্পানি থেকে টেম্বো জাতের বীজ বাংলাদেশে বাজারজাত করে কুশিয়ারা সীডস্। এরপর প্যাকেটে ভরা বীজগুলো সারা দেশে তাদের নিজস্ব পরিবেশকের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়া হয়।
টেকনিজম কোম্পানি সূত্র জানা যায়, টেম্বো টমেটো অন্যান্য জাতের তুলনায় আগাম ফলন দেয়। এটি রোদ ও বৃষ্টি সহিষ্ণু।
এ টমেটো লম্বাকৃতির ও বেশ শক্ত। এটির গড় ওজন ১২০ থেকে ১৫০ গ্রাম। রোপণের ৬০ থেকে ৬৫ দিনের মধ্যেই বাজারজাত করা যায়।
পাতা কুঁকড়ানো রোগ ও ঢলে পড়া রোগ সহনশীল জাত এটি। এ জাতের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে অন্যান্য জাতের চেয়ে জমিতে চারা বেশি লাগানো যায়। এতে কৃষকরা টমেটোর ফলন বেশি পায় এবং অনেক লাভবান হয়।
উজ্জ্বল লাল রঙের টেম্বো জাতের এ টমেটো পাকার পরও শক্ত থাকে। তাই দূরে পরিবহন করলেও টমেটোর ক্ষতি হয় না।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য
কুশিয়ারা সীডস্-এর স্থানীয় পরিবেশক আসাদ মিয়া বলেন, ‘টেম্বো টমেটো আগাম, বৃষ্টি-গরম সহনশীল এবং উচ্চ ফলনশীল হওয়ায় কৃষকদের এই বীজের চাহিদা বেশি। এ বছর টেম্বো টমেটোর বীজ অনেক কৃষক কিনে চাষাবাদ করে বাজারে ভালো দাম পেয়েছে। বলা যায়, সামনের বছরে এই জাতের টমেটো চাষ আরও বাড়বে এবং লাভবান হবে কৃষকরা।’
কুশিয়ারা সীডস্-এর মার্কেটিং অফিসার জিহাদ হাসান বলেন, ‘পরিবহনের সময় যেকোনো জাতের টমেটো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত ও নষ্ট হয়। কারণ এগুলো নরম হয়, কিন্তু টেম্বো জাতের টমেটো পাকার পরেও যেকোনো জাতের চেয়ে শক্ত।
‘ফলে পরিবহনের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। নানা গুণাগুণ বিবেচনাসহ এই দিকটি বিবেচনা করেও অনেক কৃষক টেম্বো চাষাবাদে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।’
কুশিয়ারা সীডস্-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়জুল ইসলাম লিটু বলেন, ‘সারা দেশের যেসকল কৃষক টেম্বো টমেটো চাষাবাদ করেছে, তাদের জমিতেই বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে এটি চাষাবাদে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। এ কারণে বাংলাদেশের আবহাওয়া, প্রকৃতিক দিক এবং কৃষকের চাষকৃত ফসল দেখতে সম্প্রতি ফান্স থেকে ছুটে এসেছেন টেকনিজম কোম্পানির বৈজ্ঞানিক কর্তকর্তা ম্যারিয়ন এবং টেকনিজম কোম্পানির ম্যানেজার টিবল্ট।
‘সে উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার গুচ্ছগ্রামে মাঠ দিবসের আয়োজন করে কুশিয়ারা সীডস্। এ সময় টমেটোর চাষকৃত জমি পরিদর্শন করা হয়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফ্রান্সের টেকনিজম কোম্পানির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ম্যারিয়ন বলেন, ‘বাংলাদেশের আবহাওয়ার ওপর ভিত্তি করে টেম্বো জাতের আগাম এবং উচ্চ ফলনশীল টমেটো আমরা বাংলাদেশে দিয়েছি। অন্যান্য জাতের চেয়ে এটিতে ভালো ফলন হওয়ায় কৃষকরা খুশি।
‘আমাদের দেয়া বীজগুলো অন্য জাতের টমেটোর চেয়ে নিঃসন্দেহে যথেষ্ট ভালো মানের। সারা দেশে ব্যাপকভাবে এ জাতের টমেটো চাষ করলে টমেটো উৎপাদনে বাংলাদেশে বিপ্লব ঘটবে, কৃষকরা লাভবান হবে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপপরিচালক ড. নাছরিন আক্তার বানু বলেন, ‘ময়মনসিংহ সদরের চরাঞ্চলের ইউনিয়নগুলো সবজি ভান্ডার হিসেবে খ্যাত। জেলায় গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ হাজার ৩১১ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের টমেটো চাষ হয়। এর মধ্যে শুধু সদর উপজেলাতেই এক হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে।
‘জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি টমেটো চাষ হয় সদরের বোরোরচর ও চর সিরতাসহ চরাঞ্চলের কয়েকটি ইউনিয়নে। এ বছর উৎপাদন আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন বলেই টেম্বো জাত চাষ করেছেন। কারণ একই জমিতে যে জাতের টমেটো সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হবে, কৃষকরা সেটিই চাষের আওতায় আনেন। আমিও এই জাতের ফলন দেখতে যাব।’