টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গালা গ্রামের মন তলায় সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌ চাষের ১৩০টি বাক্স বসিয়েছেন আনসার আলী। এ থেকে এ মৌসুমে ৩০ থেকে ৩৫ মণ মধু সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি।
তার ভাষ্য, সরিষা ক্ষেত থেকে মধু আহরণ করলে পরাগায়ন হয়। এতে উৎপাদন বাড়ে। তাই ক্ষেতের মালিকেরাও মৌচাষিদের উৎসাহিত করছেন।
শুধু আনসার আলী নন, জেলার ১২টি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু আহরণ চলছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকায় বাক্স বসছে। গ্রামের মাঠজুড়ে আবাদ হয়েছে সরিষার। ইতোমধ্যে ক্ষেত থেকে মৌমাছির সাহায্যে মধু সংগ্রহ শুরু হয়েছে। মধু সংগ্রহের কারণে সরিষার ফলনও বাড়ে। ফলন ভালো হওয়ায় মধু সংগ্রহ বাড়বে বলে আশা চাষিদের।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উচ্চফলন ও স্থানীয় উভয় জাতের সরিষা চাষ করেন তারা। সরিষা নভেম্বরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আবাদ করতে হয়। ফসল ঘরে ওঠতে লাগে জাতভেদে ৭০ থেকে ৯০ দিন।
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জেলার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন সরিষা ফুলের সমারোহ। কৃষকেরা যেমন ক্ষেত পরিচর্যা করছেন, তেমনি ক্ষেতের পাশে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন মৌচাষিরা।
আনসার আলী মধু সংগ্রহ করতে এসেছেন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার সোনাতলা এলাকা থেকে। তিনি বলেন, ‘১৩০টি বাক্স ৩০ থেকে ৩৫ মণ মধু সংগ্রহ করতে পারব। দেড় মাস এখানে থাকব। দেড় মাসে ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা খরচ হবে। ৬ থেকে ৭ লাখ টাকার মধু বিক্রি করতে পারব। পাইকারি ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা মণ দরে মধু বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি। মধু সরাসরি কোম্পানিতে দিয়ে থাকি। সব খরচ বাদ দিয়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ করার আশা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘মৌমাছির বাক্স বসালে ফলন ভালো হয়। তাই ক্ষেতের মালিকেরা বাক্স বসাতে সহায়তা করেন। চাকরির অবস্থা বর্তমানে ভালো না। তাই শিক্ষিত যুবকদের দিন দিন মৌ চাষে আগ্রহ বাড়ছে।’
মৌ শ্রমিক জুয়েল মিয়া বলেন, ‘এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। পরিবার থেকে খরচ দিতে পারে না। চিন্তাভাবনা করে দেখলাম একটা কিছু করতে হবে, সেজন্য মৌবাক্সের কাজ শিখতে চলে আসা। আমারও চিন্তাভাবনা আছে নিজ উদ্যোগে মৌবাক্স গড়ে তোলার। কারণ বেকার বসে না থেকে কিছু একটা করা ভালো।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার ১২টি উপজেলায় চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। জেলায় ৭৯ হাজার ৯৪১ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৮১ হাজার ৫৪০ হেক্টরে চাষ হয়েছে। গত মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৮ হাজার ১২০ হেক্টর। গত মৌসুমের চেয়ে এবার ২৩ হাজার ৪২০ হেক্টর বেশি জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। এর মধ্যে মৌ চাষের আওতায় জমি রয়েছে ১৮ হাজার ৮২ হেক্টর। মৌ স্থাপিত হয়েছে ৬ হাজার ৫৯৭টি। এখন পর্যন্ত মধু আহরণ হয়েছে ৫ হাজার ৯১৭ কেজি। জেলায় এ পর্যন্ত স্থানীয় ৩৪ জন ও অস্থায়ী মৌচাষি রয়েছে ৭৮ জন।’
কৃষি বিভাগ সূত্রে আরও জানা যায়, গত বছর কৃষকরা সরিষার ভালো দাম পেয়েছিলেন। এতে লাভবান হয়েছিলেন। এ বছরও অধিক লাভের আশায় সরকারি প্রণোদনার পাশাপাশি নিজ উদ্যোগেও অনেক কৃষক সরিষার আবাদ করেছেন।
সদর উপজেলার গালা এলাকার জাহিদ মিয়া বলেন, ‘মৌচাষিদের মধু আহরণের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সংরক্ষণের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সরকারিভাবে দেয়া প্রয়োজন। কারণ মধু সংরক্ষণ করতে পারলে মৌচাষিরা আরও বেশি লাভবান হতে পারবে।’
আল আমিন নামে আরেক চাষি বলেন, ‘মৌ চাষে খরচ অনেক। বছরে ৭ মাস মধু হয় না। এ সময় মৌমাছিকে বাঁচিয়ে রাখতে চিনি খাওয়াতে হয়। এ বছরে চিনির দামও বেশি। তাই লোকসান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক আগে থেকে মৌ চাষ করছি। সরকার যদি সরাসরি মধু সংগ্রহের ব্যবস্থা করত। তাহলে আমরা সঠিক দামটা পেতাম। এতে লাভ হতো বেশি।’
জানতে চাইলে ঢাকা অঞ্চলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক আহসানুল বাসার বলেন, ‘মৌমাছি সরিষা ক্ষেতের ফুলে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করে। এতে সরিষা ফুলে সহজে পরাগায়ন ঘটে। তাই ক্ষেতের পাশে মৌ চাষের বাক্স স্থাপন করলে সরিষা ফলন অন্তত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়ে।
‘পাশাপাশি চাষিরা মধু আহরণ করে লাভবান হন। সরিষা চাষিরা মধু সংগ্রহকারীদের বাধা না দিয়ে আরও সহযোগিতা করেন। নানাভাবে মধু সংগ্রহকারীদের কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে।’