দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলে অন্যতম চমক অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিজয়। ২৯৯টি আসনে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতেছেন, যাদের মধ্যে অন্তত ৫০ জন হারিয়েছেন জয়ী দল আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে।
হেরে যাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের চারজন কেন্দ্রীয় নেতা। এ ছাড়া হেরেছেন তিনজন প্রতিমন্ত্রী। দাপট দেখানো বা দ্রুত উত্থান হওয়া এমন দুই-একজনও পরাজয়ের স্বাদ পেয়েছেন। এই তালিকায় আছেন কমপক্ষে ১৫ জন সংসদ সদস্য (এমপি)।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান জাফর উল্যাহ এবারও হেরে গেছেন যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন চৌধুরী) কাছে। এ নিয়ে টানা তিনবার নিক্সন চৌধুরীর কাছে হারলেন জাফর উল্যাহ।
নেত্রকোণা-৩ আসনে পরাজিত হন বর্তমান এমপি ও আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। মাদারীপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান মিয়াকে (গোলাপ) বিপুল ভোটে পরাজিত করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী (ঈগল) তাহমিনা বেগম।
মুন্সীগঞ্জ-৩ (মুন্সিগঞ্জ সদর-গজারিয়া) আসনে হেরেছেন নৌকার প্রার্থী, আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস। এ আসনে জয়ী হন আওয়ামী লীগেরই স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব।
গাজীপুর-৫ আসনে হেরে যান সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও মহিলা লীগের সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি। এ আসনে জয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক ডাকসু ভিপি আকতারুজ্জামান।
মানিকগঞ্জ-২ আসনে পরাজিত হয়েছেন আলোচিত সংগীতশিল্পী মমতাজ বেগম। এবারের নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য আলোচিত বরগুনা-১ আসনের নৌকার প্রার্থী, তিনবারের এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ (শম্ভু) হেরে যান ঈগল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা আনকোরা স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম সরোয়ারের কাছে।
যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আজিজুল ইসলামের কাছে হারেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী বহুল আলোচিত শাহীন চাকলাদার। তিনি বর্তমান এমপি ও যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
রংপুর-৫ আসনে হেরে গেছেন নৌকার প্রার্থী, টকশোর পরিচিত মুখ আশিকুর রহমান রাশেক (রাশেক রহমান)। এখানে জয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী জাকির হোসেন।
কিশোরগঞ্জ-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সোহরাব উদ্দিনের কাছে হেরেছেন আবদুল কাহ্হার আকন্দ। শেরপুর-৩ আসনে হেরে গেছেন পাঁচবারের এমপি আতিউর রহমান আতিক।
প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে ঢাকা-১৯ আসনে পরাজিত হন এনামুর রহমান (নৌকা) । তিনি হেরে গেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফুল ইসলামের কাছে, যিনি একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছিলেন। শুধু ডা. এনাম নন, এ আসনের আরেক শক্তিশালী প্রার্থী তৌহিদ জং মুরাদও হেরেছেন।
বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী (হবিগঞ্জ-৪) বড় ব্যবধানে হেরেছেন যুবলীগের পদত্যাগী নেতা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জনপ্রিয় মুখ ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনের কাছে। স্থানীয় সরকার এবং সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য (যশোর-৪) আসনে হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াকুব আলীর কাছে।
কুমিল্লা-২ আসনে হেরেছেন বর্তমান এমপি ও শিল্পপতি মাতলুব আহমাদের স্ত্রী সেলিমা আহমাদ। এ আসনে বিজয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আবদুল মজিদ।
কুমিল্লা-৩ আসনে হেরেছেন আরেক শিল্পপতি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন। এখানে জয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম। কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তিনি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের শরিক হিসেবে জাতীয় পার্টি তথা জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে পিরোজপুর-২ আসন ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ, কিন্তু তারই এক সময়ের সহকারী স্বতন্ত্র প্রার্থী মহিউদ্দিন মহারাজের কাছে হেরে যান মঞ্জু।
মহিউদ্দিন ঈগল প্রতীকে ৯৯ হাজার ৭২৪ ভোট পান। আর মঞ্জু নৌকা প্রতীক নিয়ে পান ৭০ হাজার ৩৩৩ ভোট।
বরাবরের মতো এবারও দলীয় নির্বাচনি প্রতীক মশাল ছেড়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নৌকা প্রতীকে কুষ্টিয়া-২ আসন থেকে লড়াই করেন, তবে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুল আরেফিনের কাছে পরাজিত হন। ট্রাক প্রতীক নিয়ে কামারুল পান ৯৮ হাজার ৮৯৬ ভোট। ইনু পান ৭৯ হাজার ৭৯ হাজার ৭৩৫ ভোট।
টাঙ্গাইল-৮ (সখীপুর-বাসাইল) আসনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম) আওয়ামী লীগের প্রার্থী অনুপম শাহজাহান জয়ের কাছে হেরে যান। এ আসনে অনুপম শাহজাহান ৯৬ হাজার ৪০১ ভোট পান। কাদের সিদ্দিকী গামছা প্রতীকে পান ৬৭ হাজার ৫০১ ভোট।
এবার রাজশাহী-২ (সদর) আসনে তৃতীয়বারের মতো নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হয়েছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, কিন্তু কাঁচি প্রতীকের প্রার্থী অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশার কাছে পরাজিত হন। এ আসনে অধ্যক্ষ শফিকুর পান ৫৪ হাজার ৯০৬ ভোট। ফজলে হোসেন বাদশা পান ৩১ হাজার ৪৬৬ ভোট।
ঢাকা-১৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. খসরু চৌধুরীর কাছে হেরে যান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রী ও দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেরীফা কাদের। নির্বাচনে কেটলি প্রতীকে খসরু চৌধুরী ৭৯ হাজার ৮৫টি ভোট পান। শেরীফা কাদের ৬ হাজার ৪২৯টি ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়ে জামানত হারিয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। জামানত বাজেয়াপ্ত এ নেতার প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ৩ হাজার ১৯০।
সিলেট-৬ আসনে তৃতীয় হন তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মবিন চৌধুরী। নির্বাচনের আগে তাকে নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ পান ৫৮ হাজার ১২৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী সরওয়ার হোসেন পান ৩৯ হাজার ৩৮৭ ভোট। শমসের পান ১০ হাজার ৮৫৮ ভোট।
রংপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আসাদুজ্জামান বাবলুর কাছে হেরেছেন জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, যিনি দুর্নীতি, দুর্ব্যবহার ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কারণে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলেন বিভিন্ন মহলে। তিনি ট্রাক প্রতীকে পেয়েছেন ২৪ হাজার ৩৩২ ভোট। বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী আসাদুজ্জামান বাবলু পান ৭৩ হাজার ৯২৭ ভোট।
তাদের বাইরে জামালপুর-৪ আসনে সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান, রাজশাহী-১ আসনে ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী অভিনেত্রী শারমিন আক্তার নিপা মাহিয়া (মাহিয়া মাহি) এবং পাবনা-৫ আসনে গায়িকা ডলি সায়ন্তনী পরাজিত হয়েছেন।
মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে নির্বাচন করে হেরে তৃতীয় হন বিকল্পধারা বাংলাদেশের বর্তমান এমপি মাহী বি চৌধুরী।