রোববার অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট বিভাগজুড়েই দেখা গেছে নৌকা প্রতীকের জয়জয়কার। বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে ১৫টিতেই জয় পেয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থীরা। নৌকার এমন জয়ের মধ্যেও চমক দেখিয়ছেন দুই নারী, স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন তারা।
তাদের একজন জয়া সেনগুপ্তা, যিনি সুনামগঞ্জ-২ আসনে কাঁচি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। অপরজন আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী। তিনি ঈগল প্রতীক নিয়ে হবিগঞ্জ-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সিলেট বিভাগের মধ্যে এবারই প্রথম একসঙ্গে দুই নারী সরাসরি ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন। বিভাগের ১৯টি আসনে এবার আর কোনো নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেননি।
জয়া এবং কেয়া উভয়ই আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।
এই দুজনের মধ্যে তুলনামূলক কঠিন চ্যালেঞ্জে ছিলেন জয়া সেনগুপ্তা। তার আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ওরফে আল আমিন চৌধুরী পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের ছোট ভাই। শাল্লা উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হন আল আমিন। অপরদিকে, জয়া সেন বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থও। তাই এবার তার জয় নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন নেতা-কর্মীরা। তবু এলাকার ভোটাররা আবারও ভোট দিয়ে জিতেয়েছেন তাকে।
সুনামগঞ্জের পাঁচটি আসনের মধ্যে ৪টিতেই জয় পেয়েছেন নৌকার প্রার্থীরা। ব্যতিক্রম কেবল সুনামগঞ্জ-২ আসন (দিরাই-শাল্লা)। নৌকার জয়জয়কারের এই ভোটে স্রোতে বিপরীতে দাঁড়িয়ে এ আসন থেকে জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ড. জয়া সেনগুপ্তা। প্রায় ৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন কাঁচি প্রতীকের এ প্রার্থী।
ড. জয়া সেনগুপ্তা এই আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় বর্তমান সংসদ সদস্য। তিনি প্রয়াত জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী। এবারও আওয়ামী লগে থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি, তবে তাকে বঞ্চিত করে আসনটিতে এবার চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ওরফে আল আমিন চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। দলীয় মনোনয়বঞ্চিত হয়ে তাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হন তিনি।
জয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই বিএনপি না থাকা সত্ত্বেও এ আসনে ভোটের মাঠে জমজমাট লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখা দেয়।
প্রসঙ্গত, সুনামগঞ্জ-২ আসন থেকে সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জয়ার স্বামী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ফলে ভোটের মাঠে এ আসনটি সুরঞ্জিতের আসন হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী লীগের দলীয় ভোটের বাইরেও এখানে রয়েছে সুরঞ্জিতের বিশাল ব্যক্তি ইমেজ। সুরঞ্জিতের মৃত্যুর পর জয়া সেনও এখান থেকে টানা দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচন শেষে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী নৌকা প্রতীকে আল আমিন পান ৪২ হাজার ৭৫ ভোট এবং কাঁচি প্রতীকে জয়া সেনগুপ্তা ৫০ হাজার ২৯৫ ভোটারের সমর্থন পান। ফলে প্রায় ৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন জয়া সেন।
স্থানীয় কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জয়া সেনের বিজয়ের নেপথ্যে সুরঞ্জিতের ব্যক্তি ইমেজের বড় ভূমিকা ছিল। পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক অনুভূতি ও সমর্থন পেয়েছেন তিনি। জয়ার বাড়ি দিরাই উপজেলায়। আর আল আমিন চৌধুরীর বাড়ি শাল্লা উপজেলায়। স্বাধীনতার পর থেকেই এখানে দিরাইয়ের লোক এমপি হয়েছেন। ভোটও বেশি দিরাই উপজেলায়। দিরাইয়ের ভোটাররা এবারও নিজেদের এলাকায় সংসদ সদস্য রাখতে চেয়েছিলেন। এ ছাড়া আল আমিন চৌধুরীর পারিবারিক সুনাম থাকলেও কিছু ব্যক্তিগত কারণে তার সমালোচনাও ছিল। আবার জয়ার বিরুদ্ধে এলাকায় সময় না দেয়ার অভিযোগ থাকলেও ব্যক্তিগত কোনো দুর্নাম নেই। এ কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেকেই তার সঙ্গে ভোটের প্রচারে ছিলেন। এসব কারণে জয়া জয় পেয়েছেন বলে মনে করেন ভোটাররা।
জয়ের প্রতিক্রিয়ায় জয়া সেনগুপ্তা বলেন, ‘এই এলাকার ভোটাররা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে ভালোবাসেন। তার অনুসারী হিসেবে আমাকেও পছন্দ করেন। ভোটে তারা আবারও তার প্রমাণ দিয়েছেন। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ।’
অন্যদিকে, জয়ার মতো আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীও হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ ও বাহুবল) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে ঈগল প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন হবিগঞ্জ-সিলেট অঞ্চলের সংরক্ষিত আসনের সাবেক এই সংসদ সদস্য। এ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয় হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ডা. মুশফিকুর রহমান চৌধুরীকে। পরে সমঝোতায় জাতীয় পার্টিকে এই আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোহাম্মদ আবদুল মুনিম চৌধুরীকে (লাঙ্গল) সমর্থন দিলে নৌকার প্রার্থী ডা. মুশফিক মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন।
কেয়া চৌধুরী দশম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত সংসদ সদস্য ছিলেন। তার বাবা হবিগঞ্জের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী। মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য মানিক চৌধুরী ২০১৫ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। এলাকায় তার বাবার ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে। এ ছাড়া নৌকার প্রার্থী না থাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেকেই কেয়ার ঈগলের পক্ষে ভোটের মাঠে নামেন। এর ফলও মেলে ভোটে; বড় ব্যবধানেই জয় পেয়েছেন কেয়া চৌধুরী।
রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কেয়া চৌধুরী ৭৫ হাজার ৫২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী এমএ মুনিম চৌধুরী বাবু পান ৩০ হাজার ৬০৩ ভোট।
জয়ের প্রতিক্রিয়ায় কেয়া চৌধুরী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ীই আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হই। স্বতন্ত্র হলেও দলের সবাই আমার পক্ষেই ছিলেন। এ ছাড়া দল-নিরপেক্ষ ভোটাররাও আমাকে সমর্থন দিয়েছেন। সবার সহযোগিতার কারণেই আমার জয় সম্ভব হয়েছে।