ভোটকেন্দ্রে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তুলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-২ ও সিলেট-৩ আসনের ফল বাতিল করে ফের নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন এ দুটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী পাঁচজন প্রার্থী।আলাদা সংবাদ সম্মেলন করে সোমবার দুপুরে তারা এ দাবি জানান। দাবি আদায়ে প্রয়োজনে আদালতের শরণাপন্ন হবেন বলেও জানান তারা।যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন সিলেট-২ আসনে গণফোরামের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান (উদীয়মান সূর্য), জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য ইয়াহইয়া চৌধুরী, স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বিশ্বনাথ পৌরসভার মেয়র মুহিবুর রহমান (ট্রাক) এবং তৃণমূল বিএনপির মোহাম্মদ আবদুর রব (সোনালী আঁশ)। আলাদা সংবাদ সম্মেলনে একই দাবি জানান সিলেট-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া ডা. এহতেশামুল হক দুলাল।দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটের দিন রোববার রাতে প্রকাশিত ফলে এ পাঁচ প্রার্থীই দুটি আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হন। এর আগে দুপুরেই নানা অভিযোগ এনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন তারা।নগরের একটি রেস্তোরাঁয় সোমবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে সিলেট-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মুহিবুর রহমান তার বক্তব্যে বলেন, ‘নির্বাচনের দিন যেটি হয়েছে, সেটি সম্পূর্ণ একটি প্রহসনের নির্বাচন। আমরা প্রধানমন্ত্রী ও ইলেকশন কমিশনের কথায় বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছি। রোববারের এটি কোনো নির্বাচনই ছিল না। তাই আমরা বর্জন করতে বাধ্য হয়েছি।
‘আমাদের এজেন্টদের মারধর, জোরপূর্বক বের করে দেয়া, কেন্দ্র দখল করে টেবিল কাস্টসহ ব্যাপক অনিয়মের কারণে আমরা নির্বাচনের দিন দুপুর ১২টার আগেই ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নিই। পরে বেলা ২টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিই আমরা চারজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সবাই রোববারের সিলেট-২ আসনের সব কেন্দ্রের ভোট ও ফলাফল প্রত্যাখ্যান করছি এবং আবারও নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি। আমরা আমাদের আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে দুই-এক দিনের মধ্যে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হব। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পাশাপাশি আমরা আন্দোলনও চালিয়ে যাব।’
গণফোরামের প্রার্থী মোকাব্বির খান বলেন, ‘নির্বাচনের দিন আমরা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়েছি। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় ও ইলেকশন কমিশন থেকে আমাদেরকে বারবার বলা হয়েছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার হবে, কিন্তু তাদের কথায়-কাজে মিল পাওয়া যায়নি; প্রহসনের নির্বাচন উপহার দেয়া হয়েছে।’
জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইয়াহইয়া চৌধুরী বলেন, ‘আমাকে একটি সেন্টারে অবরুদ্ধ করে রেখে নৌকার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা টেবিল কাস্ট করেছেন। আমি বারবার ফোন করেও নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা প্রশাসনের কোনো সহযোগিতা পাইনি। আমি প্রায় দুই ঘণ্টা তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিলাম। এরপরই আমরা ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নিই।
‘আমাদের এজেন্টদের নৌকার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা অনেক কেন্দ্রে ঢুকতেই দেয়নি; অনেক কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে। এই অবস্থায় নির্বাচন বর্জন করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার ছিল না। তা ছাড়া প্রহসনের নির্বাচন দেখে আমি নিজেও ভোট দিইনি।’তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী আবদুর রব মল্লিক বলেন, ‘আমি একটি সূত্রে জানতে পেরেছি, আগের রাতেই ৩৮টি কেন্দ্রের ব্যালট পেপারে নৌকায় সিল মারা হয়ে গিয়েছিল। আমরা এই ৪ প্রার্থী দীর্ঘ প্রবাস জীবন কাটিয়েছি। সেখানকার সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চা এখানেও করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
‘একটি প্রহসনের নির্বাচন আমাদের উপহার দেয়া হয়েছে। আমরা এ নির্বাচনে সিলেট-২ আসনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে পুনঃভোটের আবেদন করছি। পাশাপাশি আমরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাব।’
এর আগে একই স্থানে সংবাদ সম্মেলনে সিলেট-৩ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থী ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল অভিযোগ করেন, ভোটের দিন প্রায় ৪৭টি ভোটকেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়। রোববার বিকেল ৩টার দিকে নৌকার এজেন্টরা নির্বাচন পরিচালনাকারীদের সহায়তায় জাল ভোট দেয়ার উৎসব শুরু করেন। তা ছাড়া ট্রাক প্রতীকের কর্মীদের মারধর, হুমকি-ধমকি প্রদান ও পেশিশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। এসব বিষয়ে জেলা রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করলেও তারা তা আমলে নেননি।
লিখিত বক্তব্যে ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখান করে বলেন, ‘নির্বাচনি প্রচারকালে আমার কর্মীদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য হুমকি দেয়া হয়। পোস্টার, লিফলেট ছিঁড়ে ফেলা হয়। নির্বাচনের কয়েক দিন আগে নৌকার প্রার্থীর কম্বল বিতরণ, স্কুলে অনুদানের ঘোষণা, তোরণ নির্মাণসহ নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার।
‘নির্বাচনের দিন দুপুর থেকেই শুরু হয় সন্ত্রাস আর জাল ভোটের উৎসব। সকাল থেকেই তার বিভিন্ন এজেন্টকে কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেয়া হয় ও কোনো কোনো জায়গায় ঢোকার পর বের করে দেয়া হয়।’তিনি জানান, রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বালাগঞ্জের বোয়ালজুড় বিদ্যালয় কেন্দ্রে জাল ভোট প্রদানে বাধা দিলে তার একজন কর্মীকে নৌকার সমর্থকরা দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে মারাত্মক জখম করেন। শুধু তাই নয়, আক্রান্ত ব্যক্তিকে আটকে রেখে অন্য এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। একই সময় বালাগঞ্জের বোয়ালজুড় ইউনিয়নের বিভিন্ন কেন্দ্রে হামলা, ট্রাক এজেন্টদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও কেন্দ্র্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। সোনাপুর কেন্দ্রে সব এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়। নির্বাচন পরবর্তী এখন পর্যন্ত তার নির্বাচনি এলাকায় বিভিন্ন কর্মীদের মারধর ও বাড়িছাড়া করার ঘটনা ঘটেছে।
তিনি জানান, স্থানীয় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করে ফল প্রত্যাখান করেন।ডা. দুলাল আরও বলেন, কামালবাজার জালালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রটি নৌকার প্রার্থীর। সে জন্য সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ওই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। কারণ নৌকার প্রার্থী নিজে প্রথম ভোট প্রদানের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ কার্যক্রম শুরু করবেন। সে জন্য এই অনিয়ম।এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সিলেট-২ আসন থেকে নবনির্বাচিত এমপি, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী। তার দাবি, নিশ্চিত পরাজয় জেনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা এসব মিথ্যা অভিযোগ তুলছেন।এ বিষয়ে সিলেট-৩ আসন থেকে নির্বাচিত হাবিবুর রহমানের বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।