বিএনপি ২০২২ সালটি যেভাবে শেষ করেছিল ২০২৩ সালের শুরুটাও ছিল তেমন। দলটির নেতা-কর্মীরা রাজপথে সক্রিয় থেকে সারা দেশে নিয়মিত মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। দলটির সমর্থকরা আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাত এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ১৭ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে আসার উচ্চাশা জাগিয়ে তুলেছিল।
বিএনপি সারা বছর যা কিছু করেছে তার লক্ষ্য ছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন। আর সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে আবার ক্ষমতায় যাওয়া। কিন্তু যদি নির্বাচনটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় তবে তা নয়।
কিছু প্রভাবশালী বিদেশি সরকার, বিশেষত ওয়াশিংটন তাদের লক্ষ্য অর্জনে আন্দোলনে গতি বাড়াতে কাজ করেছিল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত বছরটি বিএনপির জন্য চরম হতাশায় শেষ হয়েছে। গত দু’মাসে তাদের কর্মকাণ্ডের ওপর নতুন করে দমন-পীড়ন শুরু হয়েছে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের প্রায় সবাই হয় কারাগারে নয়তো পলাতক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ প্রশাসনের দাবি মেনে নিতে সরকারকে বাধ্য করতে ব্যর্থ হওয়ায় ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আগামী বছরগুলোতে রাজনীতিতে ফিরে আসা এবং নেতা-কর্মীদের পুনরুজ্জীবিত করা বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে।
বিএনপি আগামীতে চরম নেতৃত্ব সংকটের মুখোমুখি হবে- এমন আশঙ্কাও করেন তাদের অনেকে। কারণ বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের প্রায় দেড় হাজার নেতা-কর্মী ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং প্রায় ২৬ হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে গেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আগামীতে দলকে পুনর্গঠনের পাশাপাশি বিএনপিকে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও কৌশল নিয়ে আসতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, ‘বিএনপির অহিংস আন্দোলন ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা এবং নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের লক্ষ্য অর্জনে সফল না হলেও এটি প্রায় সব বিরোধী দল এ দাবিকে সমর্থন করে।
‘বিএনপির প্রতিটি সমাবেশে বিপুলসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে তাদের সমর্থন বেড়েছে। সংগঠনটিকে বিভক্ত করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা নেতৃত্বের বড় সাফল্য।’
ড. রিয়াজ বলেন, ‘বিশেষ করে ২৮ অক্টোবরের পর সরকারের কর্মকাণ্ডে এটা স্পষ্ট হয়, তারা আসলে বিএনপিকে বাইরে রেখেই একটি নির্বাচন করতে চেয়েছিল। সুতরাং বিএনপি বর্জন করতে চায় কি না, তা অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে।
‘আমাদের জোর দিয়ে বলতে হবে, বিএনপি একা নির্বাচন বর্জন করছে না। বিএনপির অনুপস্থিতি প্রমাণ করেছে যে, এই নির্বাচন একটি পাতানো অনুষ্ঠান।’
তিনি বলেন, ‘হাজার হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে এবং দেড় হাজারেরও বেশি নেতা-কর্মীকে দোষী সাব্যস্ত করার কারণে বিএনপি একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।
‘তবে এটা দুর্ঘটনাবশত নয়, দলকে নেতৃত্বশূন্য করার পরিকল্পনার অংশ। ২৮ অক্টোবর থেকে এর কর্মসূচিগুলো আকর্ষণ হারাচ্ছে। তবে ৭ জানুয়ারির পর এটি কী কৌশল গ্রহণ করে তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, বিএনপিকে রাজপথে ফিরে আসতে হবে এবং জনসমাবেশে অংশ নিতে হবে, তা যত কঠিনই হোক না কেন।
তিনি বলেন, ‘৭ জানুয়ারির পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কেমন হবে তার সঙ্গে বিএনপির ভবিষ্যৎ জড়িত। তাদের ভবিষ্যৎ অন্যান্য বিরোধী দল থেকে আলাদা হবে না। যে কেউ বিএনপিকে বিলুপ্তপ্রায় শক্তি বলে অভিহিত করতে চায়, সেটি স্পষ্টতই ভুল।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী বলেন, ‘পশ্চিমা দেশগুলোর চাপে সরকার তাদের রাজনৈতিক সুযোগ দেয়ায় বিএনপি ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছে।
‘সরকার যেমন ভেবেছিল, বিএনপি রাজপথে সক্রিয় থাকলে তারা ক্ষমতায় থাকতে পারবে না; তাই তারা আবারও কঠোর দমন-পীড়ন চালিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। বিএনপির রাজনীতি সঠিক পথেই চলছে এবং দলটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের দাবির পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তুলতে পারে।’
অধ্যাপক আলী রিয়াজের সঙ্গে একমত পোষণ করে ড. বেপারী বলেন, ‘বিএনপিকে সব বাধা অতিক্রম করে রাজপথে আন্দোলন জোরদার করতে হবে। কারণ আমি বিশ্বাস করি ৭ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
‘বিএনপি যদি সঠিক কৌশল নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারে, তাহলে তারা সফল হতে পারে।’
বিএনপির আন্দোলনের বিবর্তন
২০২৩ সালকে নির্বাচনি বছর হিসেবে বিবেচনা করে জানুয়ারির শুরু থেকেই সমাবেশ ও বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে কঠোর আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে বিএনপি। দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা জোরদার করার জন্য বিভিন্ন ইউনিট এবং সহযোগী সংগঠনগুলোও সংস্কার করা হয়েছে। ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করায় দলটি সাফল্য অর্জন করে।
আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে গত ২৭ জুলাই যুগপৎ এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। এক দফা দাবিতে বিএনপিসহ তিন ডজনেরও বেশি দল যুগপৎভাবে রোডমার্চসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজপথে বিএনপি ও অন্যান্য সমমনা দলের সমর্থকদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
টার্নিং পয়েন্ট ২৮ অক্টোবর
আগের কর্মসূচিগুলোতে দলের সাফল্যের সুবাদে ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জনসভা করার ঘোষণা দেয় বিএনপি। হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে অভূতপূর্বভাবে এই সমাবেশ শুরু হলেও পুলিশ ও বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষে এক পুলিশ কনস্টেবলসহ তিনজন নিহত ও কয়েক শ’ আহত হওয়ার পর তা মাঝপথে ভণ্ডুল হয়ে যায়।
সংঘর্ষের পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর অভিযান শুরু করে এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে গ্রেপ্তার করে। শেষ পর্যন্ত রাজপথে বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনুপস্থিতিতে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।
২৮ অক্টোবরের ঘটনার পর দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশের অধিকাংশ কার্যালয় তালাবদ্ধ রাখা হয়। ১৬ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মী বিজয় শোভাযাত্রা বের করলেও তারা তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় খোলেনি।
বিএনপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত দুই মাসে পুলিশ দলটির প্রায় ২৪ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন ২৫ জন নেতা-কর্মী।
এছাড়া পাঁচ থেকে দশ বছর আগের বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় বিএনপির তিন ভাইস চেয়ারম্যানসহ দেড় হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে সাজা দেয়া হয়। আদালতের মাধ্যমে মামলাগুলো পুনরুজ্জীবিত করা ও রায় দেয়া হয়।
ফিরে এল হরতাল-অবরোধ
২৮ অক্টোবর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের পর বিএনপির আন্দোলন গতি হারানোয় দীর্ঘদিন পর হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করে দলটি।
বিরোধী দলগুলো ২৯ অক্টোবর থেকে ১২ দফায় ২৩ দিন দেশব্যাপী অবরোধ এবং চার দফায় পাঁচ দিন হরতাল পালন করে। অবশেষে বিরোধী দল ২০ ডিসেম্বর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়, যা কার্যত জনগণের মধ্যে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়।
৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন এবং আওয়ামী লীগ সরকারকে সহযোগিতা না করার আহ্বানের পক্ষে জনসমর্থন আদায়ে দেশব্যাপী গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ২০২৩ সাল শেষ ও ২০২৪ সাল শুরু করতে যাচ্ছে দলটি।
নির্বাচন বর্জন
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি পূরণ না হওয়ায় বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় নির্বাচন বর্জন করছে দলটি।
বিএনপি ও সমমনা বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করলেও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমরসহ প্রায় ২৪ জন মধ্যম পর্যায়ের নেতা দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
২৮ অক্টোবরের সহিংসতার মামলায় গ্রেপ্তার শাহজাহান ওমর জামিনে মুক্তি পাওয়ার একদিন পর আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন।
বিএনপির শরিকদের মধ্যে কেবল কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
বিএনপির নেতারা দাবি করেন, সরকার দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে অথবা ভয়াবহ পরিণতির ভয় দেখিয়ে নির্বাচনে আনার চেষ্টা করেছে। তবে শাহজাহান ওমর ছাড়া অন্য কোনো বড় নেতা চাপের মুখে বিএনপি ছাড়েননি।
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে শঙ্কা
লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস, হার্ট, চোখের সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিদায়ী বছর জুড়ে বেশ কয়েকবার চিকিৎসা নিয়েছেন।
৭৮ বছর বয়সী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী ৯ আগস্ট শেষবারের মতো বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
২৬ অক্টোবর খালেদা জিয়ার পেট ও বুকে পানি বৃদ্ধি এবং লিভারে রক্তক্ষরণ বন্ধে ট্রান্সজুগুলার ইন্ট্রাহেপাটিক পোর্টোসিস্টেমিক শন্ট (টিআইপিএস) নামে পরিচিত হেপাটিক পদ্ধতি সম্পন্ন করেন যুক্তরাষ্ট্রের তিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
সফল হেপাটিক অপারেশনের পর থেকে খালেদা জিয়ার অবস্থার উন্নতি হলেও তিনি এখনও শঙ্কামুক্ত নন বলে চিকিৎসকরা তাকে ছাড়পত্র দেননি। সূত্র: ইউএনবি