দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের দুটি আসন পেয়েছে জাতীয় পার্টি। এ দুই আসনে লাঙ্গলের প্রার্থীদের ‘চ্যালেঞ্জ’ জানাতে ভোটের মাঠে সরব রয়েছেন আওয়ামী লীগের চারজন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম–৫ আসনে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ গত তিনবারের এমপি। এদিকে চট্টগ্রাম–৮ আসনে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান সোলায়মান আলম শেঠ শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে যাচ্ছেন বলে ধারণা ভোটারদের। কারণ এ আসনে শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, এ দুই আসনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা একাধিক প্রার্থীর পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।
আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা বলছেন, এ দুই আসনে কোনো প্রার্থীর পক্ষে দলের নেতা-কর্মীরা প্রচারে অংশ নেবেন, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা তারা কেন্দ্র বা স্থানীয় পর্যায় থেকে পাননি। তবে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে এবার সারা দেশেই দলের নেতা-কর্মীরা স্বতন্ত্র হিসেবে প্রার্থী হওয়ায় এ দুই আসনেও স্বতন্ত্রদের পক্ষে মাঠে নামতে কোনো বাধা দেখছেন না তারা।
ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির টিকিটে বিজয়ী হন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। পরবর্তী সময় ক্ষমতার পালাবদলে সরকারে আসে জাতীয় পার্টি। এর পর ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে তিনি বিএনপি ছেড়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন।
জাতীয় পার্টি থেকে একই আসনে ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এই নির্বাচনের তিন বছরের মধ্যে ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনেও তিনি জাতীয় পার্টির টিকিটে জয়ী হন। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির টিকিটে বিজয়ী হন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনেও বিজয়ী হন তিনি।
২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে তিনি জাতীয় পার্টির টিকিটে নির্বাচন করলেও সমর্থন পান আওয়ামী লীগের। তাই ওই তিনটি নির্বাচনে তিনি সহজে জয়ী হন। কিন্তু ভোটাররা মনে করছেন, এবার তিনি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম-৫ হাটহাজারী
হাটহাজারী উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ও ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ড নিয়ে চট্টগ্রাম–৫ আসন। ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ১০ হাজার। এ আসনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছিলেন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম। কিন্তু আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিলে ১৭ ডিসেম্বর তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। জাতীয় পার্টির লাঙল প্রতীকের প্রার্থী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ২০০৮ সাল থেকে টানা তিনবার সংসদে এ আসনের ভোটারদের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
তিনবারই নৌকার মনোনয়ন পেয়েছিলেন এম এ সালাম, পরে দলের সিদ্ধান্তে সরে দাঁড়ান। এবার চতুর্থবারের মত সরে দাঁড়ালেন এম এ সালাম।
এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহাজাহান চৌধুরী (কেটলি প্রতীক) এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাছির হায়দার করিম বাবুল (ঈগল প্রতীক)। এছাড়া বিএনএফ এর আবু মো. শামসুদ্দিন (টেলিভিশন), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির কাজী মহসীন চৌধুরী (একতারা), ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশের সৈয়দ হাফেজ আহমদ (চেয়ার), তৃণমূল বিএনপির মো. নাজিম উদ্দিন (সোনালী আঁশ) ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের সৈয়দ মোখতার আহমেদ (মোমবাতি) ভোটে লড়ছেন।
উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম বলেন, ‘দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছিল। আবার দলের সিদ্ধান্তে আমি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছি। দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তাতে আমার বলার বা করার কিছু নেই। কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের কারণে কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী আছে। তাই দলের নেতা-কর্মীরা কিছু এদিকে কিছু ওদিকে।’
দলের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহাজাহান চৌধুরীর পক্ষে কাজ করছেন।
এ বিষয়ে সালাম বলেন, ‘শাহজাহান ছাত্রলীগ করে এসেছেন। এখন আওয়ামী লীগ নেতা। দলের নেতা-কর্মীরা উনার জন্য খাটবেন এটাই তো স্বাভাবিক।’
অক্টোবরে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ফোরাম নামের নতুন দল গঠন করে এর আহ্বায়ক হন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি মো. নাজিম উদ্দিন। নিবন্ধন না থাকায় পরে তিনি তৃণমূল বিএনপি থেকে এই আসনে প্রার্থী হয়েছেন।
মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘অন্য অনেক সংসদীয় আসনের তুলনায় আমাদের এলাকায় শান্তিপূর্ণ। মনে হয় ভালো নির্বাচন হবে। আমরা চাই ভোট নিয়ে মানুষের মাঝে যে অনীহা আছে সেটা কেটে যাক। ভোটার নিজের ইচ্ছে মতো ভোট দিক, কিন্তু ভোটকেন্দ্রে আসুক।’
জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ অবশ্য তার সামনে বড় কোনো বাধা দেখছেন না।
তিনি বলেন, ‘শেষ তিনবারসহ মোট ছয়বার আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকতেই পারে। তাতে অসুবিধা নেই। প্রার্থী বেশি থাকলে ভোটারও বেশি আসবে কেন্দ্রে।’
চট্টগ্রাম-৮ আসন
অপরদিকে নগরীর পাঁচলাইশ–চান্দগাঁও এলাকায় সিটি করপোরেশনের পাঁচটি ওয়ার্ড এবং বোয়ালখালী উপজেলার আটটি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম–৮ সংসদীয় আসনে ভোটার মোট ৫ লাখ ৪৩ হাজার। গত এপ্রিলে উপ–নির্বাচনে জয়ী হয়ে এখানে সংসদ সদস্য হন নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদ।
এবারও তিনি দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান সোলায়মান আলম শেঠকে ওই আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হলে নোমান প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।
এ আসনে স্বতন্ত্র হিসেবে ভোটের লড়াইয়ে আছেন নগর আওয়ামী লীগের কোশাধ্যক্ষ ও সাবেক সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম (কেটলি) এবং নগর কমিটির সদস্য সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর বিজয় কুমার চৌধুরী (ফুলকপি)। এছাড়া বিএনএফ এর এস এম আবুল কালাম আজাদ (টেলিভিশন), তৃণমূল বিএনপির সন্তোষ শর্মা (সোনালী আঁশ), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের সৈয়দ মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন (চেয়ার), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মোহাম্মদ ইলিয়াছ (হাতছড়ি), এনপিপির মো. কামাল পাশা (আম), বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. মহিবুর রহমান বুলবুল (ডাব) এবং বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মো. আব্দুন নবী (মোমবাতি) প্রতীক নিয়ে এই আসনে নির্বাচন করছেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতা আবদুচ ছালামকে শক্ত প্রার্থী হিসেবেই দেখছেন স্থানীয়রা।
আবদুচ ছালাম বলেন, ‘অতীতে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতিনিধি হিসাবে চট্টগ্রামের উন্নয়নে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে নগরীকে সুরক্ষা দিতে অনেক মেগা প্রকল্প আমি প্রিয় নেত্রীর কাছ থেকে অনুমোদন নিতে সক্ষম হয়েছি। বিজয়ী হলে আমি এলাকার জনগণকে উন্নয়ন উপহার দেব।’
আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা বিজয় কুমার চৌধুরী বলেন, ‘নগর ও উপজেলা আওয়ামী লীগ আমার সঙ্গে আছে। আমি ছাত্রলীগ করেছি। নগরীর জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলাম। বোয়ালখালীর সন্তান হিসেবে আমি এলাকার মানুষের সমর্থন পাব।’
সোলায়মান আলম শেঠ জানান, এর আগে কখনও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হননি তিনি। গতবার তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির হয়ে মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছিলেন। পরে দলীয় সিদ্ধান্তে তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন।
তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার উপর আস্থা রেখেছেন বলে আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দারা আমার জন্য কাজ করছেন। আশা করি আমি ভালো ফল পাব। কালুরঘাট সেতু হবে বলে আমি আশাবাদী। বিজয়ী হলে সবার জন্য সমান উন্নয়ন হবে বোয়ালখালীতে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, ছালাম কেটলি প্রতীক নিয়ে প্রচারণায় অনেকটা এগিয়ে গেছেন, গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন সমানে। নির্বাচনে নতুন মুখ হলেও চট্টগ্রাম-৮ আসনে তার নাম এখন মুখে মুখে। জাতীয় পাটির সোলায়মান আলম শেঠ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয় কুমার চৌধুরীও প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন সমানতালে।
স্থানীয়রা জানায়, বোয়ালখালীর প্রধান সমস্যা কালুরঘাট সেতু। মূলত ‘কালুরঘাট সেতু’ নির্মাণ এ আসনের ভোটারদের প্রধান দাবি। সবশেষ উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগের নোমান আল মাহমুদও এটি নির্মাণের আশ্বাস দেন। নির্বাচনে জয়ী হয়ে তারা প্রত্যেকে জাতীয় সংসদে গিয়ে দফায় দফায় সেতু নির্মাণের দাবি তুলে ধরে বক্তব্য দেন। ধরনা দেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে কালুরঘাট সেতুও আর নির্মাণ হয় না। তাতে দুঃখ ঘোচে না বোয়ালখালীবাসীর।
এবারের নির্বাচনেও দাবিটি সামনে নিয়ে আসেন ভোটাররা। গণসংযোগে গিয়ে প্রার্থীরাও আশ্বাস দিচ্ছেন নির্বাচিত হলে সেতু নির্মাণের। এটি নির্মাণে যে প্রার্থীর উপর ভোটাররা ভরসা রাখতে পারবেন, নির্বাচনে তারই জয়ের মালা পরার সম্ভাবনা বেশি বলে মন্তব্য করেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।