যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর নির্দেশনায় ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি ও বর্তমান যুবদল নেতা মো. ইখতিয়ার রহমান কবির গাজীপুরের শ্রীপুরে রেললাইন কাটেন বলে জানিয়েছে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
সোমবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, ‘রাজধানীতে গাড়িতে ভাঙচুর, আগুন দেয়া ও বোমা বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। সাধারণ মানুষ রেলকে নিরাপদ বাহন হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল। কিন্তু ট্রেনে চলাচল করা মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে ও রেল চলাচল বিঘ্ন করতে নাশকতার পরিকল্পনা করে। পাশাপাশি নাশকতার মাধ্যমে রেলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটানোর উদ্দেশ্য ছিল।’
সিটিটিসির প্রধান বলেন, ‘এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যুবদলের শীর্ষ নেতা সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর নির্দেশে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি ইখতিয়ার রহমান কবিরকে নির্দেশনা দেয়া হয়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কবির গাজীপুর ছাত্রদলের দুই নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
‘তারা হলেন গাজীপুরের আজিমুদ্দিন সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক তোহা, গাজীপুর মহানগর ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুম। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। তাদের বলা হয়, স্থান নির্বাচন করে নাশকতা সফল করার জন্য। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য তোহা ও মাসুম মিলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান আজমল ভূঁইয়ার বাসায় একটি মিটিং করে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কৌশল ঠিক করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রেললাইনের নাট-বল্টু খুলে ট্রেন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা। কিন্তু তারা নাট-বল্টু খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর বিষয়টি কবিরকে জানানো হয়। পরে কবির রেললাইন কাটার নির্দেশ দেয় পাশপাশি রেললাইন কাটার জন্য লোকবল দেয়ার কথা জানায়। এজন্য তিনি লালবাগ থানার ২৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি ইমন হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রথমে ইমনকে বড় লোহার পাত কাটা শেখার জন্য টাকা দেন।
‘ইমন লোহা কাটার প্রশিক্ষণ নেন। এরপর স্থানীয়ভাবে গ্যাস সিলিন্ডার কেনা হয়। আর লোহা কাটার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য যন্ত্রপাতি ঢাকা থেকে কেনা হয়। কবির, ইমন, তোহা ও মাসুম মিলে রাজধানীর পুরান ঢাকার নবাবপুর মার্কেটের একটি দোকান থেকে সব যন্ত্রপাতি ১০ ডিসেম্বর কিনে ইমনের বাসায় রাখেন।’
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী ১২ ডিসেম্বর ইমনের বাসা থেকে যন্ত্রপাতি গাজীপুর নিয়ে যাওয়া হয়। একই দিন ইমন ও কবির কমলাপুর থেকে ট্রেনে করে জয়দেবপুর রেলস্টেশনে যায়। এরপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, তোহা ও মাসুম চলাচলের জন্য মাইক্রোবাস ভাড়া করা, গ্যাস সিলিন্ডার কেনাসহ সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। ওই সময়ে তারা ট্রেনের শিডিউল জেনে রাখে। এরপর ১৩ তারিখ রাতে স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খাওয়ার পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে রওনা দেয়।
‘ওই সময় বেশ কয়েকজনকে পথ থেকে তুলে নেয়া হয়। পরবর্তীতে ঘটনাস্থলে মোট নয়জন একত্রিত হয়ে রেললাইন কাটার কাজ শুরু করেন। আগে থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া ইমন অন্যদের সহযোগিতায় রেললাইন কাটেন। এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী কবির পরিকল্পনা করা এবং বাস্তবায়নের সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।’
সিটিটিসির প্রধান বলেন, ‘এই নাশকতার উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষের মনে ভয় সৃষ্টি করা, ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন করা এবং মানুষ যেন রেলে যাতায়াত না করে এই লক্ষ্যে তারা রেললাইন কাটেন। পরবর্তীতে ঘটনাস্থলে দুটি গ্যাস সিলিন্ডার ফেলে রেখে যায় তারা। অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে তারা ঢাকায় চলে আসে। ভাড়া করা মাইক্রোবাস তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গেটে নামিয়ে দেয়। পরবর্তী সময়ে রেল কাটার যন্ত্রপাতি ইমনের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।
‘ওই সময় কবির বেশ কিছু টাকা দেয় ইমনকে। পরবর্তীতে রেল কাটায় ব্যবহৃত মালামাল রেখে তারা আত্মগোপনে চলে যায়। রেল কাটা সফল হয়েছে বলে কবির নির্দেশদাতা টুকুকে জানিয়ে দেয়। পরবর্তীতে কবিরকেও বড় অংকের টাকা পাঠায় নির্দেশদাতা।’
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘হোতা কবিরসহ গ্রেপ্তার আরও একজন হলেন লালবাগ থানার ২৪ নম্বর ওয়ার্ড মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি মো. ইমন হোসেন। কবির এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন গত ২৮ অক্টোবর থেকে যাত্রাবাড়ি, ডেমরা, নিউমার্কেট, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০টিরও বেশি বাসে আগুন দিয়েছে। এই রেল লাইন কাটার নির্দেশদাতা, পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়াও নাশকতার বেশ কয়েকটি ঘটনায় তার নাম এসেছে।
‘এর আগে পুরান ঢাকার বংশাল এলাকায় গান পাউডারসহ ছাত্রদল কর্মী গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদেও কবিরের নাম এসেছে। বিশেষ করে মহানগর দক্ষিণ এলাকায় যত নাশকতা ঘটেছে তার বেশিরভাগ ঘটনার মূল পরিকল্পনা ও নির্দেশদাতা হিসেবে তিনি জড়িত বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে।’
সিটিটিসির প্রধান বলেন, ‘ডেমরায় বাসে আগুনের ঘটনায় চালকের সহকারী নিহতের ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তাকে আমরা খুঁজতে ছিলাম। সবকটি ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কবিরকে আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ডে আনা হবে।’
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের কোনো নেতার নির্দেশনা ছিল কি না জানতে চাইলে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে কেউ নির্দেশদাতাদের মধ্যে যুবদলের সভাপতি সালাউদ্দিন টুকু। টুকু তাকে ডেকে জানায়, উপর থেকে রেলে নাশকতার নির্দেশ আছে। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে কবিরকে দায়িত্ব দেয়া হয়।’