রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী ফুয়াদ আল খতিবের মৃত্যুর কারণ জানতে আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে। পুলিশ বলছে ময়না তদন্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদন পেতে সময় লাগবে। প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুর কারণনিশ্চিত করে বলা যাবে না।
শহীদ শামসুজ্জোহা হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ফুয়াদকে কক্ষ থেকে উদ্ধার করার সময় যে আলামত দেখেছেন তার সহপাঠি ও বন্ধুরা তাতে বড় কোনো অস্বাভাবিকতা তাদের চোখে ধরা পড়েনি। তারপরও মরদেহের রং কালো হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন তারা। আর সে কারণেই এটা স্বাভাবিক মৃত্যু কী না তা নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে।
মূলত ফুয়াদের এই অকালে চলে যাওয়াকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না বন্ধু-সহপাঠিরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের তদন্তের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ঘটনাটির তদন্ত করছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলের ১৮৪ নম্বর কক্ষে রোববার নিজের বিছানায় ফুয়াদের নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়। হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার জানান, অনেকক্ষণ আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। ফুয়াদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায়।
ফুয়াদের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে রাবি প্রশাসনের পক্ষ থেকে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শহীদ শামসুজ্জোহা হলের আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটির সদস্যরা হলেন আবাসিক শিক্ষক রবিউল ইসলাম, ড. ইসমাইল হোসেন ও কে. এম. মনিরুল ইসলাম।
শামসুজ্জোহা হলের প্রাধ্যক্ষ একরামুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি পুলিশ, সিআইডি ও পিবিআই তদন্ত করছে। পাশাপাশি হল কর্তৃপক্ষ অধ্যাপক মো. হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে চার সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটিকে দশ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
‘ময়না তদন্ত করা হয়েছে। যতটুকু শুনলাম রিপোর্ট পেতে এক মাসের মতো সময় লাগবে। এরপরই সব কিছু জানা যাবে।’
এদিকে ফুয়াদের কয়েক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুয়াদ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন। যার রেজাল্ট এখনও হয়নি। আর গত শুক্রবার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে পরীক্ষা দিয়ে শনিবারই ক্যাম্পাসে ফিরেছিলেন।
ফুয়াদের সহপাঠী ও পাশের রুমমেট মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু বলেন, “শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে ফুয়াদ রুমে আসে। সাড়ে ৭টার (আনুমানিক) দিকে বিভাগের আরেক বন্ধুর সঙ্গে মোবাইলে তার (ফুয়াদ) কথা হয়। ফুয়াদ তাকে বলে- ‘আমি বাসা থেকে মাত্র আসলাম। ভালো লাগছে না। ঘুমাবো।’
“এরপর রাত ৯টার দিকে আমার আরেক বন্ধু ফোন দিয়ে আমাকে বলে, ‘ফুয়াদ ফোন ধরছে না। ওর রুমে একটু যা।’ আমি বলি কেন? তখন সেই বন্ধু বলে, ‘কাল সকাল ৯টায় এক স্যারের কাছে যেতে হবে ওকে (ফুয়াদ) নিয়ে। তখন আমি গিয়ে ওর রুমে (১৮৪) নক দিলাম। তখন সে (ফুয়াদ) কোনো কথা বলেনি। আমি ভাবলাম হয়তো ঘুমাচ্ছে, তাই বেশি ডাকিনি। তখন ওর রুমের দরোজা লাগানো ছিল।”
মিন্টু আরও বলেন, “পরদিন (রোবার) সকাল ৯টা-সাড়ে ৯টার দিকে আমি ও পাশের রুমের এক বন্ধু বসে গল্প করছিলাম। তখন খেয়াল করলাম ওর (ফুয়াদ) রুমের দরজা খোলা। দেখা যাচ্ছে যে রুমে শুয়ে আছে (শুধু পা দেখা যাচ্ছে)। তাই ডাকলাম না। পরে গ্রুপের পরীক্ষা থাকার কারণে চলে গেছি।
“বিকেল ৩টা ৫ কি ১০ মিনিটের দিকে রুমে আসি। কিন্তু রুমে না ঢুকে ক্যান্টিনে খেতে যাচ্ছি। তখনও দেখি রুমে আগের মতোই শুয়ে আছে ফুয়াদ। তখন আমার খটকা লাগলো যে সকাল থেকে ফুয়াদ ওভাবেই শুয়ে আছে (শুধু পা দেখা যাচ্ছে)? তখন পাশের রুমমেটকে ডেকে বলি, সকাল থেকে ফুয়াদ শুয়ে আছে। খেয়েছে কি? তখন আমরা দু’জন এসে ডাকলাম, শুনলো না। গায়ে ধাক্কা দিলাম তাও কোনো নড়াচড়া নাই। যখন ধরে টান দিলাম একদম শক্ত হয়ে গেছে। আর সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। তখন বুঝলাম মারা গেছে।”
তিনি আরও বলেন, ‘দেখলাম যে ব্লিডিং হয়েছে এবং তা তোশকেও অনেকখানি পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সাথে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দিলাম এবং বিভাগের গ্রুপে জানালাম। প্রভোস্ট স্যারকে ফোন দিলাম। স্যার আসতে দেরি হলো দেখে অ্যাম্বুলেন্স আসার সঙ্গে সঙ্গে ওকে তুলে রাজশাহী মেডিক্যালে নিয়ে গেলাম। পরে ডাক্তার বললো যে, অনেক আগেই মারা গেছে।
‘ডাক্তার বলেছেন যে আনুমানিক তিন ঘণ্টা আগে মারা গেছে। তবে আমার মনে হয়, অনেক আগেই মারা গেছে। কারণ, সকালে যেভাবে দেখে গেছি এসেও দেখি সেভাবেই শুয়ে আছে। ভোরবেলা উঠেছিল মনে হয়। কারণ প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে সে। আর রুমের দরোজাও খোলা ছিল।’
মিন্টু আরও বলেন, “ওর গায়ে কাঁথা জড়ানো ছিল। মশারি টাঙানো ও তা তোশকের নিচে গোঁজা ছিল। ডান পাশে কাত হয়ে শুয়ে ছিল এবং ফোনটা ঠিক বালিশের পাশেই ছিল। অস্বাভাবিক কিছুই দেখিনি। ডাক্তার বলেছে, ম্যাসিভ স্ট্রোক করলে এমনটি হয়। কিন্তু তারপরও আমরা চাই এর একটি ভালো তদন্ত হোক। কারণ তার শরীরে কিছু ‘সিম্পটমও’ ছিল। সারা শরীরে কালো কালো দাগ হয়ে গেছিলো। বুক, মুখ সব কালো হয়ে গেছিলো।”
একই বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী মিঠু বলেন, ‘ওইদিন সকালে ওকে (ফুয়াদ) ওজু করতে দেখেছি।’
ফুয়াদের খুব কাছের এক বন্ধু রাশেদ বলেন, ‘ওর পরিবার নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না। আমার সাথে দেড় বছর ছিল। কোনো অসুস্থতাও দেখিনি। খুবই ভালো একটা ছেলে। ফুয়াদের বড় ভাই রাজশাহীতেই থাকে। ওইদিন রাতে বড় ভাইয়ের সাথে খাওয়া-দাওয়া করেই ফুয়াদ রুমে ফিরেছিল।’
প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হল বলেন, ‘পুলিশ এখনও ময়না তদন্ত রিপোর্ট হাতে পায়নি। এই রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এ ব্যাপারে হল প্রশাসনকে বলা আছে, তারা খোঁজখবর নিচ্ছে। ময়না তদন্ত রিপোর্ট হাতে এলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে।’