গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দরিদ্র জনগণের আয় বৃদ্ধি, দেশের সর্বত্র খাদ্য সরবরাহের ভারসাম্য আনতে এবং দারিদ্র্য বিমোচনে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে সারা দেশে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) ও কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। কিন্তু এর ব্যতিক্রম নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা।
প্রকল্পের টাকা দরিদ্র শ্রমিকদের পকেটে যাওয়ার বদলে ঢুকেছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদের পকেটে। প্রকল্প বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, প্রকল্পের নামে এক কোদাল মাটি পর্যন্ত খোঁড়া হয়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ, কাগজে-কলমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বরাদ্দকৃত অর্থ ও খাদ্যশস্য হাপিশ করেছেন তারা।
সরেজমিনে গিয়ে মহাদেবপুরে কাবিখার ‘নাটশাল বটতলীর পাকা রাস্তা হতে আনোয়ারের মিল পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার’ এবং ‘মহাদেবপুর কলেজ রোড পাইকড়ের গাছ হতে ব্র্যাক অফিস হয়ে নজরুল বাবুর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার’ প্রকল্পের কোনো অস্তিত্ব মেলেনি। কিন্তু এ বছরের জুন মাসে কাগজে-কলমে প্রকল্প দুটি শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে বলে রিপোর্ট দেয়া হয়েছে।
গত পাঁচযুগ থেকে মহাদেবপুর উপজেলার নাটশাল গ্রামে বসবাস করছেন ৬০ বছর বয়সী নরেশ পাল। অথচ ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) প্রকল্পের আওতায় তাদের গ্রামে বাস্তবায়িত ‘নাটশাল বটতলীর পাকা রাস্তা হতে আনোয়ারের মিল পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার’ প্রকল্পের বিষয়ে কিছুই জানেন না তিনি।
জানতে চাইলে নরেশ পাল বলেন, ‘গত ১৫ বছর আগে একবার এই রাস্তায় মাটি কাটার কাজ হয়েছে। এরপর আর সংস্কার তো দূরের কথা, এক কোদাল মাটি পর্যন্ত খোঁড়া হয়নি।’
নওগাঁর মহাদেবপুরে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে কাবিখা প্রকল্পের আওতায় ৫ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হলেও নাটশাল বটতলী-আনোয়ারের মিল সড়কে এক কোঁদাল মাটি পর্যন্ত খোঁড়া হয়নি। ছবি: নিউজবাংলা
শুধু নরেশ পাল একা নয়, এমন কোনো প্রকল্পের কাজ হতে দেখেননি বলে নিশ্চিত করেছেন ওই গ্রামের মকলেছার, খলিল, আজিজুল ইসলাম, শহিদুল ইসলামসহ অনেকেই।
এ ছাড়া একই অর্থবছরে কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) প্রকল্পের অধীনে ‘মহাদেবপুর কলেজ রোড পাইকড়ের গাছ হতে ব্র্যাক অফিস হয়ে নজরুল বাবুর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার’ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মহাদেবপুর সদর ইউপি কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে। তবে এ প্রকল্পের কাজেরও কোনো অস্তিত্ব মেলেনি।
ওই এলাকার মনিমালা, আব্দুল জব্বার, অনিতাসহ ১০-১২ জন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, গত কয়েক বছরে রাস্তাটি সংস্কার করা হয়নি। এটি এখন চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
কাবিটা প্রকল্পের আওতায় ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও কলেজ পাড়া পাইকড়ের গাছ-নজরুল বাবুর বাড়ি সড়টির এখনও বেহাল দশা। ছবি: নিউজবাংলা
স্থানীয়দের অভিযোগ, কাজ না করেই নামসর্বস্ব শ্রমিকের তালিকা তৈরি করে ভূয়া মাস্টার রোলের মাধ্যমে বরাদ্দের অর্থ ও খাদ্যশস্য পরিশোধ দেখিয়েছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার যোগসাজশে অস্তিত্বহীন প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাত করেছেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। শুধু তাই নয়, বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
স্থানীয় সুশাসন বিশ্লেষকদের মতে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে আরও কঠোর হতে হবে। দুর্নীতিবাজদের লাগাম টেনে ধরতে দেশের প্রচলিত আইনে বিচার করে শাস্তি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
সরকারি প্রকল্পে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
সম্প্রতি মহাদেবপুর সদর ইউপি কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পের আওতায় উপজেলার নাটশাল গ্রামে ‘নাটশাল বটতলীর পাকা রাস্তা হতে আনোয়ারের মিল পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার’ এবং উপজেলা সদরের কলেজ পাড়া এলাকায় ‘মহাদেবপুর কলেজ রোড পাইকড়ের গাছ হতে ব্র্যাক অফিস হয়ে নজরুল বাবুর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার’ নামে পৃথক দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এর একটিতে পাঁচ টন চাল ও অপরটিতে চার লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মহাদেবপুর সদর ইউপি সদস্য শিহাব রায়হান ও জান্নাতুল ফেরদৌসী। কাগজে-কলমে ‘প্রকল্পের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে’ উল্লেখ করে বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্য ও অর্থ উত্তোলন করেছেন পিআইসির সভাপতি ও সম্পাদক।
মহাদেবপুরে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের কাবিখা ও কাবিটার বাস্তবায়নকৃত প্রকল্পের তালিকা।
কাজ না করেই বরাদ্দের অর্থ ও খাদ্যশস্য আত্মসাতের বিষয়ে মোবাইল ফোনে বক্তব্য দিতে রাজি হননি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও মহাদেবপুর সদর ইউপি সদস্য শিহাব রায়হান। প্রতিবেদককে তিনি সামনাসামনি ‘দেখা করতে’ বলেন।
অন্যদিকে প্রকল্পের বিষয়ে তেমন কিছুই জানাতে পারেননি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মুলতান হোসেন। তিনি বলেন, ‘দেখতে হবে প্রকল্পের কী অবস্থা।’
তার যোগসাজশে অস্তিত্বহীন ওই দুটি প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি অর্থ ও খাদ্যশস্য আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কৌশলে এড়িয়ে যান এ সরকারি কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে মহাদেবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান সোহাগের বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনিও এ প্রতিবেদককে ‘অফিসে এসে দেখা করতে’ বলেন।