আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর গত ২৯ অক্টোবর সকাল ৬টায় যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল। সেই হিসাবে বুধবার (২৯ নভেম্বর) পর্যন্ত টানেল যুগে এক মাস পাড়ি দিয়েছে দেশ। এই এক মাসে সব মিলিয়ে ১ লাখ ৭৫ হাজার ১৯৭টি যানবাহন বঙ্গবন্ধু টানেল পাড়ি দিয়েছে বলে জানিয়েছে সেতু বিভাগ। এসব যানের বিপরীতে টোল আদায় হয়েছে ৪ কোটি ১২ লাখ ২১ হাজার টাকা।
২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু টানেলের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে ২০২৫ সাল পর্যন্ত টানেল দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ যানবাহন চলাচল করতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ১৭ হাজার ২৬০টির বেশি যান চলাচলের কথা এ টানেল দিয়ে। তাছাড়া সম্ভাব্য যান চলাচলের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে আদায় করা টোল থেকে ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে ১২৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। টানেল উদ্বোধনের পরবর্তী ৫০ বছরে শূন্য দশমিক ১৬৬ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
তবে টানেল চালুর পর সেতু বিভাগের তথ্য বলছে, গেল এক মাসে গড়ে দৈনিক ৫ হাজার ৬৫২টি যান বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে চলাচল করেছে। আর টোল হিসেবে দৈনিক গড়ে আয় হয়েছে ১৩ লাখ ২৯ হাজার ১০০ টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। যান চলাচলের সংখ্যা ও লক্ষ্যমাত্রার এত বিশাল তারতম্যে টানেল থেকে সরকারের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এই এক মাসে টানেল দিয়ে যেসব যান চলাচল করেছে তার অধিকাংশই ব্যক্তিগত। এখনও টানেল দিয়ে নির্দিষ্ট কোনো রুটের গণপরিবহন চালু হয়নি। তাছাড়া দূরপাল্লার অনেক বাস এখনও শাহ-আমানত সেতু দিয়ে কর্ণফুলি পাড়ি দিচ্ছে। ফলে বঙ্গবন্ধু টানেলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে চলাচলকারী সব যানবাহনের চাপ পড়ছে না।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী তানভীর রিফা বলেন, ‘টানেল দিয়ে এখনও পুরোপুরি বাণিজ্যিক যান চলাচল শুরু হয়নি। কারণ দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও মাতারবাড়ীকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি।’
অন্যদিকে টানেলের বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া প্রতি ৫ বছর পর পর টানেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের প্রতিস্থাপন ব্যয় ধরা হয়েছে ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে টানেল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছরে খরচ হবে আরও ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার।
টানেল নির্মাণে ব্যয় করা প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে দুই শতাংশ সুদে বাংলাদেশকে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয় চীন। ২০২৫ সাল থেকে টানেলের আয় দিয়ে সেই ঋণ পরিশোধ করবে সরকার। কিন্তু বর্তমানে যে হারে টোল আদায় হচ্ছে তা চলতে থাকলে বছরে আয় হবে ৪৯ কোটি ৪৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা, যা প্রায় ৪ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ডলারের সমান। এমন পরিস্থিতিতে টানেলের আয় দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ ও যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন ব্যয় মেটানোই কঠিন হয়ে পড়বে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
তবে ২০১৩ সালের সমীক্ষায় মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মিরসরাই-কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়ক, মীরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পাঞ্চল ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন নানা শিল্প কারখানা চালু হওয়ার বিষয়টি হিসেবে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এবং মিরসরাই-কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়ক এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি। এমনকি দক্ষিণ চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন শিল্প কারখানাগুলোও তাদের কার্যক্রম এখনও পুরোদমে চালু করেনি। এসবের কারণে শুরুতে তুলনামূলক কম যান চলাচলকে অনেকটা কাঙ্ক্ষিত হিসেবেই ধরে নেয়া হচ্ছে।
এদিকে টানেলের প্রভাবে আনোয়ারা-পটিয়া এলাকায় ব্যাপক শিল্পায়ন ও বছরে অন্তত ১৭ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের কথা সমীক্ষায় বলা হলেও এখনও তা কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। তাই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও টানেলের পুরোপুরি সুফল পেতে এখন থেকেই চট্টগ্রামে সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা মাথায় রেখে মহাপরিকল্পনা সাজানোর কথা বলছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, ‘ফিজিবিলিটি স্টাডিজে অনেক কিছু দেখা যায়, কিন্তু ইনিশিয়ালি (প্রাথমিক অবস্থায়) এত গাড়ি হবে না। কারণ গাড়ি ওদিকে কী জন্য যাবে? ওখানে কী এমন ইন্ডাস্ট্রি হয়েছে যে গাড়ি যাবে? ওদিক থেকে কেনই বা গাড়ি আসবে? ওখানে তো সেই ডেভেলপমেন্টটা (উন্নয়ন) এখনও হয়নি। কাজেই টানেল দিয়ে এত তাড়াতাড়ি গাড়ি যাবে না। বিষয়টা হলো যে, ওই দিকে গাড়ি জেনারেট করার মতো তো সেরকম ডেভেলপমেন্ট হয়নি। ওরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছে ঠিক আছে, কিন্তু সেদিকে যদি শিল্পায়ন না হয় তাহলে তো গাড়ি যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
টানেল দিয়ে যান চলাচল কম হওয়ার কারণ হিসেবে টোলের তুলনামূলক বেশি হারকেও দোষেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের এই নেতা। তিনি বলেন, ‘ওইদিকে যেহেতু আপনার কাজ নাই, আপনি তো যাচ্ছেন না বা যাবেন না। আর ওই দিকে কাজ থাকলেও আপনি এখন কোন দিক দিয়ে যাবেন? আপনি টানেল দিয়ে গেলে আপনার টোল দিতে হবে কত, আর শাহ আমানত ব্রিজ দিয়ে গেলে টোল দিতে হবে কত? এগুলো তো টাকা, এই চড়া দ্রব্যমূল্যের বাজারে টাকার হিসেব তো করবেই জনসাধারণ।
‘যাদের কাঁচা টাকা আছে, গাড়ি আছে, তারা যাবে। বাস গেলে তো বাসে অনেক টোল নেয়, সাধারণ মানুষ তো বাসে যাবে না। একটা ৩০ সিটের বাস গেলেও তো ৩০০ টাকা টোল নেয়। মানে প্রতি জনের ঘাড়ে দশ টাকা করে বেশি পড়বে। তাহলে বাসচালকও তো যাত্রী পাবে না। সাধারণ মানুষ কেন অতিরিক্ত টাকা পে (পরিশোধ) করবে? এতদিন যেগুলো গেছে প্রথম প্রথম, এগুলো তো সব টুরিস্ট বাস। ফিজিবিলিটি স্টাডিজে যে পূর্বাভাস দিয়েছে, এ অঞ্চলে ওই রকম যানবাহন হতে আরও অনেক বছর সময় লাগবে।’
‘লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী টোল আদায় না হলে স্বপ্নের এ টানেল অনেকটা হাতি পোষার মতো হবে’ জানিয়ে টানেলের সুফল পেতে এর দু’পাশে পরিকল্পিত নগরায়নের পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, ‘আর এখন টোল টেক্সট যদি না পাই, এগুলো আমাদের জন্য হোয়াইট এলিফ্যান্ট (শ্বেতহস্তী) হয়ে যাবে।
‘টানেল হয়ে গেছে এখন আর কিছু করার নেই। দু’পাশেই শিল্পায়ন করতে হবে; পরিকল্পিত নগরায়ন, টার্মিনাল- এগুলোর সবই করতে হবে। এখন সেগুলো এই পরিস্থিতিতে কবে হবে তার কোন ঠিক নেই।’
অবকাঠামো ও অবস্থানগত কারণে টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ পদ্মা সেতুর চেয়েও বেশি হবে বলে জানান এ নগর পরিকল্পনাবিদ।
তার সুরে সুর মেলালেন আরেক নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামকে ঘিরে আগামীর বাংলাদেশকে মাথায় রেখে এখন থেকেই মহাপরিকল্পনা সাজাতে হবে যাতে এই অঞ্চলে পরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল, আবাসিক এলাকা ও পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা যায়। এখানে এসবের উপাদানগুলোও রয়েছে। এ কাজগুলো করলে টানেল ব্যবহারে পণ্যবাহী যানবাহনের পাশাপাশি অন্যান্য যানবাহনও বাড়বে।’
গত ২৮ অক্টোবর বেলা ১১টা ৪১ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে খোলে দেশের দখিনা দুয়ার। দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত এটাই প্রথম টানেল।
এর আগে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং টানেল নির্মাণকাজের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এরপর ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলের প্রথম টিউব নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন।
টানেলটি নির্মাণ করেছে চীনা কোম্পানি চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। শুরুতে প্রকল্প ব্যয় ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা ধরা হলে ২০১৭ সালে তা বাড়িয়ে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা করা হয়।