দেশের সর্বশেষ সীমান্তবর্তি জেলা কুড়িগ্রামে বাংলাদেশ-ভারতের হারিয়ে যাওয়া রেল সংযোগ পুনরায় চালুর দাবি স্থানীয়দের। এই রেল সংযোগ চালু হলে সেভেন সিস্টারসহ ভুটান, নেপালের সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে ট্রানজিট হিসেবে গুরুত্ব পাবে বাংলাদেশ ও ভারতের কাছে।
জানা যায়, বৃটিশ আমলে ১৮৮৭ সালে তৎকালীন ‘নর্দান বেঙ্গল রেলওয়ে’ বেঙ্গল ও আসামের সঙ্গে যোগাযোগ সুবিধা সম্প্রসারনের লক্ষ্যে রেলপথ চালু করে। আসামের ধুবড়ি জেলার গোলকগঞ্জ দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সোনাহাট, পাটেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী রেলস্টেশন অতিক্রম করে ভারতের বামনহাট, নিউগীদালদহ এবং গীদালদহ রেলস্টেশন হয়ে একটি পথ ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। অন্য পথটি বাংলাদেশের মোগলহাট দিয়ে লালমনিরহাটে অভ্যন্তরে চলে যায়।
১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান বিভক্তির পরও কিছুদিন ট্রানজিটের মাধ্যমে এই রেল পথ চালু ছিলো। এ পথে ভারতের বিভিন্ন অংশে রেলপথে অল্প খরচ এবং কম সময়ে ভ্রমণ করা যেত। এছাড়াও এই রেলপথের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার উৎপাদিত পাট, চা, তামাক, চামড়া, ধান, চাল ও শালকাঠ ভারতে রপ্তানি করা হতো। ভারত থেকে কয়লা, পাথর, লুবলেকেটিং ওয়েল, ডিজেলসহ অন্যান্য মালামাল আমদানিও করা হতো ওই পথে। কিন্তু ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর ভূরুঙ্গামারীর অংশে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ভারতের রাধিকাপুর, বিরল, পার্বতীপুর, তিস্তা, গীতলদহ এবং গোলোকগঞ্জ হয়ে যাওয়া একটি মিটারগেজ লাইন বিহারের কাটিহারের সঙ্গে আসামের ফকিরা গ্রামকে সংযুক্ত করেছিল। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান ও ভারত রেল ট্র্যাফিক পুনরায় চালু করার বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯৫৫ সালে মোগলহাট-গীতলদহ রেললাইন চালু হয়। মোগলহাট-গোলকগঞ্জ সেকশনটি মিটার গেজ রেল লাইন ছিলো যা মোগলহাট বর্ডার দিয়ে বের হয়ে ভারতের গীতালদহ-আবু তারাফ-বামনহাট হয়ে আবার বাংলাদেশের কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারি উপজেলার শিংঝাড় সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে।
বাংলাদেশ সীমানায় পশ্চিম-পূর্বমূখী অবস্থিত এই আড়াআড়ি সেকশনের ভূরুঙ্গামারি, জয়মনিরহাট, পাটেশ্বরী এবং সোনাহাট হয়ে আবারও ভারতে ঢুকে গোলকগঞ্জ পর্যন্ত যায়। পরে ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারতের দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় মোগলহাট-গোলকগঞ্জ রেললাইন বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ভূরুঙ্গামারী উপজেলার মধ্যে ভূরুঙ্গামারী, পাটেশ্বরী ও সোনাহাট রেল স্টেশনে রেলের লাইন, বগি ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ পড়ে ছিলো।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে উলিপুরের মাঈদুল ইসলাম যখন যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন ঐসময় রেল লাইন গুলো সরিয়ে নিয়ে উলিপুরের সঙ্গে রেল সংযোগ তৈরি করা হয়। আর রেলের বগিসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ ওই সময় হাওয়া হয়ে যায়। সর্বশেষ প্রায় ১৫ কিলোমিটার রেলপথের পাথরগুলো খালেদা জিয়ার শাসনামলে নাম মাত্র মূল্যে ক্রয় করে প্রভাবশালী নেতারা তা মাটি খুড়ে তুলে নেয়। এসময় সোনাহাট রেলওয়ে সেতু রক্ষা বাঁধের পাথরগুলোও অপসারণ করা হয়। সময়ের ব্যবধানে পরিত্যক্ত এসব রেল লাইনের পাথরসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি চুরি হয়ে যায়। আস্তে আস্তে রেলের জমিও বেদখল হয়ে পরে।
ভূমি অফিসের তথ্যমতে, সোনাহাটের বানুর কুটি মৌজায় ২৯ দশমিক ৮৪ একর, গনাইরকুটি মৌজায় ৪৪ দশমিক ৬৯ একর, ভরতের ছড়া মৌজায় ৫০ দশমিক ৬৩ একর, পাইকেরছড়া ইউনিয়নের ছিট পাইকেরছড়া মৌজায় ৬২ দশমিক ৩৪ একর, পাইকেরছড়া মৌজায় ৫৯ দশমিক ৩৪ একর বেলদহ মৌজায় ৩৪ দশমিক ৩ একর, জয়মনিরহাট ইউনিয়নের শিংঝাড় মৌজায় ১৯ দশমিক ৫৩ একর, বড়খাটামারী মৌজায় ১৬ দশমিক ২০ একর, ছোটখাটামারী মৌজায় ৩১ দশমিক ৮৫ একর করে সর্বমোট ৩৪৮ দশমিক ৫৫ একর রেলের সম্পতি রয়েছে। এরমধ্যে কিছু জমিতে ভাসমান ভূমিহীন মানুষ এবং অনেক অংশে প্রভাবশালীরা দখল করে পাকা ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মাটি বিক্রি করে পুকুর তৈরী করে রেখেছে।
ধরলা নদী দারা বিচ্ছিন্ন নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী এবং ফুলবাড়ি উপজেলার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি এই এলাকায় পুনরায় রেল পথ চালু করা হোক। এলাকাবাসীর দাবি সোনাহাট রেল স্টেশন থেকে জয়মনির হাট পর্যন্ত রেলপথ রয়েছে। এখান থেকে ৩৮ কিলোমিটার রেলপথ তৈরীর মাধ্যমে রেল চালু করা সম্ভব।
অন্যদিকে ভূরুঙ্গামারীর শিংঝাড় থেকে ফুলবাড়ি হয়ে শেখ হাসিনা ২য় ধরলা সেতুর ওপর দিয়ে লালমনিরহাট পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার সংযোগ করলে সোনাহাট স্থলবন্দর থেকে পুরাতন রেল পথটি চালু করা সম্ভব। এছাড়া ভারতের সঙ্গে ট্রানজিটের মাধ্যমে পুরাতন রেল পথটি চালু করা সম্ভব। সোনাহাট স্থলবন্দর থেকে কুড়িগ্রাম পুরাতন রেল স্টেশন পর্যন্ত রেল পথ স্থাপিত হলেই তিন উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ রেল সুবিধা পাবে বলেও জানান এলাকাবাসী।
শিংঝাড় এলাকার বাসিন্দা শতবর্ষী শামসুল হক বলেন, ‘কতসালে সেটা আমার মনে নেই, তবে এতটুকু বলতে পারি আমি এই রেল পথে বামনহাট রেল স্টেশনে ১২ পয়সা দিয়ে টিকিট করে ট্রেনে করে দিনহাটা গিয়ে নেমেছি। সেখানে হাট বাজার করে আবারও ফিরে আসছি। এই রেল পথ আবারও চালু হলে এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য ঘুরে যাবে। আমরা চাই রেল পথটি চালু হোক।’
একই এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘স্বাধীনতার পর আমি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ চলে আসি। সেই থেকে এখানেই বসবাস করছি। আমার বাবা-মা ভারতের কোচবিহার জেলার সাহেবগঞ্জ থানায় বসবাস করেন। দুইবার ভিসা করে সেখানে গিয়েছিলাম। ভারতের রেল যোগাযোগ অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু আমাদের বামনহাট-সোনাহাট রেল যোগাযোগ বিলিন হয়ে গেছে। এটা পুনরায় চালু দুই দেশের জন্যই ভালো হবে।’
ব্যবসায়ী শাহজাহান আলী সোহাগ বলেন, ‘এই রেল পথ পুনরায় চালু হলে ভারতের সিভেন সিস্টারসহ ভুটান ও নেপালের সঙ্গে ব্যবসার পরিধি বাড়বে বাংলাদেশের। এতে করে কুড়িগ্রাম জেলার কর্মসংস্থানসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।’
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক (ডিসি) সাইদুল আরীফ বাংলাদেশ-ভারতের রেল পথটি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘পুনরায় এই রেল পথটি সচল করার জন্য সরকারের দৃষ্টিতে আনার প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেবার চেষ্টা করবো আমি।’