দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নপত্র ক্রয় ও জমাদান শেষ হয়েছে। এতে কোনো কোনো আসনে ২০ জনের বেশি মনোনয়নপ্রত্যাশী পাওয়া গেছে। কেউ কেউ একাধিক আসনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে এক আসনে একই পরিবারের দুই বা ততধিক সদস্যের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ নিযে। কোথাও বাবা-ছেলে, কোথাও ভাই-ভাই, কোথাও ভাই, বোন, ভগ্নিপতির মনোনয়নপত্র সংগ্রহ নিয়ে দলটিতে চলছে মুখরোচক আলোচনা ও সমালোচনা।
এক আসনে একই পরিবারের একাধিক সদস্যের মনোনয়নপত্র সংগ্রহের বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি এটাকে ‘রুটি ভাগাভাগির সমতুল্য’ বলে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘এরা মনে করছে মনোনয়ন পেলেই জয় নিশ্চিত। আর যেহেতু রাজনীতি এখন একটি ব্যবসার মতো আর সংসদ সদস্য বনে গেলে তো কথাই নেই, অনেক সুযোগ-সুবিধা। তাই একই পরিবার থেকে অনেক সদস্য মনোনয়ন চান।’
একই পরিবারের সবচেয়ে বেশি সদস্যের মনোনয়নপত্র সংগ্রহের ঘটনা ঘটেছে ঠাকুরগাঁও-২ (বালিয়াডাঙ্গী-হরিপুর) ও পাবনা-৪ (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) আসনে।
ঠাকুরগাঁয়ে দলীয় মনোনয়নের জন্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দবিরুল ইসলাম, তার ছেলে, মেজো ভাই, ভাতিজাসহ চারজন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। দবিরুলের বড় ছেলে ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ মাজহারুল ইসলাম সুজন, এ নেতার মেজো ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী এবং ভাতিজা বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আলী আসলাম জুয়েলও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
পাবনা-৪ আসনে দলীয় মনোনয়নের জন্য প্রয়াত সাবেক সংসদ সদস্য শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর দুই ছেলে ও মেয়ে, জামাতাসহ চারজন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। পরিবারের বড় মেয়ে মাহজেবিন শিরিন পিয়া, দুই ছেলে গালিবুর রহমান শরীফ, সাকিবুর রহমান শরীফ, জামাতা আবুল কালাম আজাদ মিন্টু আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র জমা দেন।
কক্সবাজার-৩ (সদর, রামু ও ঈদগাঁও) আসনে সংসদ সদস্য প্রার্থী হতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তিন সহোদর। তারা হলেন আসনটির বর্তমান সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল, তার বড় ভাই ও রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল এবং তাদের ছোট বোন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কাবেরী। এই তিনজন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সংসদ সদস্য ওসমান সরওয়ার আলমের সন্তান।
কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসন থেকে নৌকার প্রার্থী হতে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নপত্র কেনে প্রয়াত সংসদ সদস্য (এমপি) আফাজ উদ্দীন আহমেদের তিন ছেলে। নৌকার প্রার্থী হতে চাওয়া তিন ভাই হলেন আফাজ উদ্দীন আহমেদের বড় ছেলে নাজমুল হুদা পটল বিশ্বাস, মেজো ছেলে আরিফ আহমেদ বিশ্বাস ও ছোট ছেলে দৌলতপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এজাজ আহমেদ মামুন বিশ্বাস।
যশোর-২ (ঝিকরগাছা ও চৌগাছা) আসন থেকে নৌকার প্রার্থী হতে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নপত্র কেনেন বাবা ও ছেলে। বাবা-ছেলে হলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম ও তার ছেলে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোস্তফা আশিষ ইসলাম।
এ বিষয়ে মোস্তফা নিউজবাংলাকে জানান, গত নির্বাচনে তার বাবা মনোনয়ন চাননি, শুধু তিনি চেয়েছিলেন, কিন্তু পাননি। এবার বাবা-ছেলে দুজনই চেয়েছেন। যেকোনো একজনকে মনোনয়ন দিলে বাবা-ছেলে এক হয়ে কাজ করবেন।
একই ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি-তিতাস) আসনের বেলায়ও। এখান থেকে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী সংসদ সদস্য সুবিদ আলী ভূঁইয়া ও তার ছেলে দাউদকান্দি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেজর মোহাম্মদ আলী সুমন। ইতোমধ্যেই বাবা এবং ছেলে উভয়েই আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র কিনে তা পূরণ করে জমাও দিয়েছেন।
আবার এমন ঘটনাও আছে যে, নিজের আসনে ছেলে মনোননয়ন পাইয়ে দিতে বাবা নিজেই দলীয় কার্যালয়ে ছেলের সঙ্গে গিয়ে মনোনয়নপত্র দিয়েছেন। মঙ্গলবার ছেলে মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিমের মনোনয়নপত্র জমা দিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যান ঢাকা-৭ আসনের এমপি হাজি সেলিম।
জাসদের এক সময়ের আধ্যাত্মিক নেতা প্রয়াত কর্নেল তাহেরের এক ছোট ভাইয়ের আসনে এবার মনোনয়ন চেয়েছেন আরেক ছোট ভাই। নেত্রকোণা-৫ আসনের (পূর্বধলা উপজেলা) জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য তার ছোট ভাই ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল।
বেলাল পূর্বধলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। আর আনোয়ার হোসেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) স্থায়ী কমিটির সদস্য। তারা দুজনেই প্রয়াত কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই।
কুয়েতে দণ্ডিত সাবেক এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম আওয়ামী লীগের হয়ে ভোটে লড়তে দুই আসনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলাম লক্ষ্মীপুর-২ ও কুমিল্লা-২ আসনের জন্য মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন পাপুল। পরে তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য করিয়ে আনেন।
এদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের নামে পাঁচটি আসনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। তার নামে ঢাকা-৬, ঢাকা-৮, ঢাকা-১৪ এবং মাদারীপুর-২ ও মাদারীপুর-৩ আসনের মনোনয়নপত্র কেনা হয়েছে। সংখ্যা বিবেচনায় কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।