বৃহস্পতিবার সকালে বাড়ির সামনে থেকে নিউ মার্কেট যাওয়ার উদ্দেশ্যে রিকশাচালককে ভাড়া জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, ‘৪০ টাকা দিবেন।’ আমি বললাম, ‘ভাড়া তো ৩০ টাকা, ৪০ টাকা চাইছেন কেন?’ মাঝ বয়স চালক বললেন, ‘ভাড়া ৩০ টাকাই ১০টা টাকা ধরিয়ে দিয়েন মামা। ভাড়া পাচ্ছি না, আয় ইনকাম একদমই কম।’
রাজি হয়ে রিকশায় উঠে বসলাম। রিকশা চলা শুরু হলো, সেইসঙ্গে রিকশাচালক নিজে নিজেই বলতে লাগলেন তার কথা- এমনিতেই ভাড়া পাচ্ছি না, আবার রিকশার জমা বাড়ায়ে দিয়েছে ১০০ টাকা। আগে রাতে ৩/৪ শ’ টাকা বাড়ি নিয়ে যেতে পারতাম। সেটা দিয়ে কোনোমতে বউ পোলারে নিয়া চলছিলাম। ২ সপ্তাহ ধইর্যা ২ শ’ টাকায় আয় হয় না। আবার জিনিসের যে দাম! এক কেজি পিঁয়াজ কিনতেই তো এক শ’ টাকা যায়। অন্যান্য কোনো জিনিসের দামই কম না। চাল, ডাল, তেল, সবজি কেনা খুব কষ্টের হয়ে গেছে মামা; মাছ-ডিম বাদই দেন। এরকম চললে তো কয়দিন পর মানুষের কাছে হাত পাততে হইব।
জানতে চাইলাম, ‘এখন ভাড়া কম হচ্ছে কেন?’ বললেন, ‘অবরোধে তো বাস-ট্রাক চলছে না। এ কারণে বাইরে থেকে মানুষ শহরে আসতেছে না। শহরে বাইরের মানুষ না আসলে ভাড়া পাব ক্যামনে?’
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া শোধ করছি, এমন সময় সামনে এসে হাজির হলেন ষাটোর্ধ্ব এক দিনমজুর। হাতে একটি কোদাল আর মাটি তোলা ডালি। বললেন, ‘মামা কাজ নাই, খাবার নাই; কয়টা টাকা দেন।’
নাম কী? কোথা থেকে এসেছেন?- জানতে চাইলে নিজের নাম বললেন আব্দুল কাদের। এসেছেন চারঘাট থেকে। বললাম, ‘কী কাজ করেন?’ বললেন, ‘যে যে কাজ দেয় সেটাই করি। মাটিকাটা, জমি পরিষ্কার করা, বালু বা ইট তোলা সবই। সকাল থেকে বসে আছি, কেউ কাজে নেয়নি।’
কবে কাজ পেয়েছিলেন?- জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘পরশু কাজ পাইছিলাম, তাতে সাড়ে চার শ’ টাকা ইনকাম হইছে। কিন্তু দুই দিনে তা শেষ হয়ে গেছে। আজ কাজ নাই, ঘরে খাবারও নাই, কয়টা টাকা দেন।’
আমি বললাম, ‘টাকা দেয়া হবে। আগে বলেন কাজ নাই কেন?’ আব্দুল কাদের উত্তর দিলেন, ‘জানি না তো বাবা! মানুষের বাড়িতে এমনিতেই কাজ কম পাচ্ছি। একদিন কাজ পেলে ৩/৪ দিন পাচ্ছি না। অটোতে চড়ে ভাড়া দিয়ে আসছি আর খালি হাতে ফিরে যাচ্ছি। ভাড়াটাই লোকসান। আবার বাড়িতে বউ-বাচ্চা আশা করে বসে আছে।’
কথা হয় আরও কয়েকজন রিকশা ও অটোরিকশাচালকের সঙ্গে। তাদের বক্তব্যও প্রায় একই। শহরে মানুষ কম, ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না; আয় কম, খরচ বেশি; অটো মালিকদের জমার টাকা দেয়ার পর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার মতো টাকাই থাকছে না; সংসার চালানো কষ্টের হয়ে গেছে ইত্যাদি।
গত কয়েকদিন ধরে চলা হরতাল-অবরোধের প্রভাবে এভাবেই চরম কষ্টে দিন কাটছে খেটে খাওয়া মানুষের।
বিপদে আছেন পরিবহন শ্রমিকরাও
বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর ডাকা অবরোধ শুরুর পর থেকে পরিবহন শ্রমিকরাx পড়েছেন চরম বেকায়দায়। অবরোধ চলাকালে রাজশাহী থেকে দুরপাল্লার সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ থাকছে। উপজেলা পর্যায়ে অল্প পরিসরে কিছু বাস চলছে।
পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা বলছেন, এসব রুটেও যাত্রীর সংখ্যা খুবই কমে গিয়েছে। এ কারণে অনেক্ষণ পরপর গুটিকয়েক বাস চলছে।
ট্রাক চলাচলের সংখ্যাও অতি নগণ্য। ফলে বাস ও ট্রাক শ্রমিকরা চরম কষ্টে দিন পার করছেন। পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটছে তাদের।
জানতে চাইলে রাজশাহী পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান ইসলাম বলেন, ‘রাজশাহীর পরিবহন শ্রমিকরা ভালো নেই। দুঃখ-কষ্ট নিয়েই দিন কাটছে। একেক জন শ্রমিক একদিন ডিউটি করলে ৩ শ’ থেকে সর্বোচ্চ ৭ শ’ টাকা পর্যন্ত আয় করে। এখন তারা প্রতি চার দিন পর একদিন ডিউটি পাচ্ছে। চার দিনে ৩শ’ টাকা বা ৭ শ’ টাকা আয় করে কীভাবে সংসার চলবে বলেন?’
রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মতিউল হক বলেন, ‘রাজশাহীতে প্রায় পাঁচ হাজার বাস শ্রমিক তালিকাভুক্ত। এর মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার নিয়মিত কাজ করে। অবরোধে এসব শ্রমিকরা কিছুটা হলেও সঙ্কটে পড়েছে। তবে এখন অবরোধেও রাজশাহী থেকে নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোর পর্যন্ত বাস চলাচল করছে বলে ক্ষতি কিছুটা কম।’
আগামী দিনগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আবারও হরতাল অবরোধের সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থায় খেটে খাওয়া মানুষের আর্থিক দুরাবস্থা বাড়বে বলেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।