বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘ভোট দেয়ার সাহস হারিয়ে ফেলেছি’

তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ঠাকুরগাঁও জেলা শাখার সদস্য সচিব মাহাবুব আল রুবেল বলেন, ‘নির্বাচন এলেই দেখা যায় ভোট কেন্দ্রগুলো কোনো রাজনৈতিক দলের দখলে থাকে। তখন সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে বা স্বাধীন মতামত দিতে ভয় পায়। এর জন্য নির্বাচন কমিশনের যেভাবে নিরাপত্তা জোরদার করা প্রয়োজন সে ধরনের নিরাপত্তা ভোট কেন্দ্রগুলোতে দেখি না।’

সময়টা ২০২২ সালের ২৭ জুলাই। ঠাকুরগাঁও বাচোর ইউনিয়নে বুধবার ছিল ইউপির ভোট। বিকেলে ভাংবাড়ি ভিএফ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণার পর মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া শুরু হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুলি করে পুলিশ।

ওই সময় কেন্দ্রের পাশে ভাংবাড়ি বেল মার্কেটের সামনে এক বছর বয়সী আশাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মা মিনারা বেগম। গুলিতে ছোট্ট আশার প্রাণ যায় মায়ের কোলেই। সন্তানের মাথার খুলি উড়ে যাওয়ার মতো বীভৎস দৃশ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে আর্তনাদ করছিলেন মিনারা।

নিজ কাঁধে সন্তানের মরদেহ বহন করে দাফন করেছেন ফেরিওয়ালা মজুর বাবা মো. বাদশা।

বাদশা জানান, ওই সময় অনেকে অনেক সান্ত্বনা আর প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে আর কেউ খোঁজ রাখেনি তার পরিবারের। নির্বাচনের কথা আসলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে মেয়ের মাথার খুলি উড়ে যাওয়া বীভৎস মৃত মুখ। তাই ভোট নিয়ে আর কোনো আগ্রহ নেই তার।

তিনি বলেন, ‘ভোট দেয়ার সাহস হারিয়ে ফেলেছি।’

ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলে গত বছর ২৭ জুলাই ইউপি নির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণ যায় এক বছর বয়সী সুরাইয়া আক্তার আশার।

ওই দিন রাতেই তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক। আশার মায়ের হাতে তুলে দেয়া হয় নগদ ৫০ হাজার টাকা।

এ ঘটনায় ২৮ জুলাই নিউজবাংলায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

ওই সময় জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর হোসেন বলেছিলেন, ‘সারা দিন সুষ্ঠু পরিবেশে ভোট চলেছে। ভোটের ফল ঘোষণা শেষে কেন্দ্র ত্যাগ করার সময় পরাজিত মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকরা আমাদের মোবাইল টিম ও সদর সার্কেলের ওপর হামলা করে।

‘কিছু সময় পর পরিস্থিতি আরও অস্বাভাবিক হয়ে যায়। আমাদের সদস্যদের ওপর তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা শুরু করে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লাঠিচার্জ করে। এতে পরিবেশ আরও বেশি খারাপ হওয়ায় জানমাল রক্ষায় পুলিশ চার রাউন্ড রাবার বুলেট ছুড়ে।’

এসপি বলেন, ‘ঘটনায় শিশুটি মারা যায়। আসলে কীভাবে মারা গেল তা এখনও জানা যায়নি। এর জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’

তিনি এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি তখন।

এর পর কেটে গেছে এক বছরেরও বেশি সময়। সন্তান হারিয়ে শোকে কাতর আশার বাবাকে আশ্বাসের অংশ হিসেবে দুটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি, চিকিৎসার খরচসহ পরিবারটিকে নানা রকম সহায়তার কথা বলা হয়।

কিন্তু বাদশার অভিযোগ, একটি ঘর পেলেও আরেকটি ঘরের জন্য ধরনা দিয়েও ঘর পাননি তিনি। তার চিকিৎসার ওষুধ পত্রের সহায়তার কথা বললেও, তা দেয়া হয়নি তাকে। এমনকি পরে কোনো খোঁজও নেয়া হয়নি পরিবারটির।

আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছেন জানতে চাইলে বাদশা বলেন, ‘ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার সাহস হারিয়ে ফেলেছি। ভোট কেন্দ্রে কোনো নিরাপত্তা নাই। আবারও গুলি চলবে না, আমার মাথার খুলি উড়বে না, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।’

প্রতিবেদককে উল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বাদশা জানতে চান, ‘আপনি বলেন এত ঝুঁকি নিয়ে কি কারো ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়া ঠিক হবে?’

এর আগে গত ২৭ ডিসেম্বর ২০২১ সালে ইউপি নির্বাচনে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউনিয়নে নির্বাচনী সহিংসতায় গুলিতে নিহত হন স্থানীয় কৃষক হামিদুর রহমান।

ওই সময় ঠাকুরগাঁও পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেছিলেন, ‘মেম্বার প্রার্থীর নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে সরকারি কাজে বাধা দেয় একটি পক্ষ। সেখানে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার নির্দেশে পুলিশের গুলিতে একজন মারা গেছেন।’

সম্প্রতি নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে নিহত কৃষক হামিদুর রহমানের ছেলে হাসিবুল ইসলাম বলেন, ‘সেদিন আমার বাবা ভোট কেন্দ্রের পাশে বাজারে অবস্থান করছিল। বিকেলে কেন্দ্রে ফলাফল নিয়ে উত্তেজনা ছড়ালে পুলিশ গুলি চালায়; আমার বাবা নিহত হন।’

নিহত কৃষকের মেয়ে মাহফুজা বেগম বলেন, ‘নির্বাচনী সহিংসতায় বাবাকে হারিয়েছি, বিচার চাইনি। কার কাছে বিচার চাইব। আমরা কোনো ক্ষতিপূরণও পাইনি।’

এ ছাড়াও গত ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর নির্বাচনী সহিংসতায় জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায় বিজিবির গুলিতে তিনজন নিহত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়।

নিহতরা হলেন পীরগঞ্জ উপজেলার ঘিডোব গ্রামের আদিত্য কুমার রায়, হাবিবপুর গ্রামের মো. সাহাবুলি ও ছিট ঘিডোব গ্রামের মোজাহারুল ইসলাম। এ ছাড়াও নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনায় আহত হয়েছেন একাধিক নারী পুরুষ।

স্বজন হারানো এসব এসব মানুষগুলোর কাছে নির্বাচন যেন এক আতঙ্কের নাম।

এর আগে ভোট কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন ঠাকুরগাঁওয়ের আবুল হোসেন সরকার ডিগ্রি কলেজের সিনিয়র লেকচারার মাহামুদ হাসান।

তিনি বলেন, ‘ভোট কেন্দ্রে আমরা যারা প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসাররা দায়িত্ব পালন করি, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে সব সময় শঙ্কায় থাকি। ভোট কেন্দ্রের ভেতরে ও বাহিরে যারা দায়িত্ব পালন করেন সবারই নিরাপত্তা জোরদার করা দরকার।

‘এদিকে বরাবরই ভোট কেন্দ্রে নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয় পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণের বাহিরে যাওয়ায় ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা গুলি চালাতে বাধ্য হয়।’

এ বিষয়ে কথা হয় তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ঠাকুরগাঁও জেলা শাখার সদস্য সচিব ও সমাজকর্মী মাহাবুব আল রুবেলের সঙ্গে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় ভোট কেন্দ্র কেন এত সহিংসতা প্রবণ ও এর থেকে উত্তোরণের উপায় কী?

মাহাবুব আল রুবেল বলেন, ‘নির্বাচন এলেই দেখা যায় ভোট কেন্দ্রগুলো কোনো রাজনৈতিক দলের দখলে থাকে। তখন সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে বা স্বাধীন মতামত দিতে ভয় পায়। এর জন্য নির্বাচন কমিশনের যেভাবে নিরাপত্তা জোরদার করা প্রয়োজন, সে ধরনের নিরাপত্তা ভোট কেন্দ্রগুলোতে দেখি না।’

তিনি বলেন, ‘এ ছাড়াও ফলাফলকে কেন্দ্র করে কোনো পক্ষ পেশিশক্তি প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। এ জন্য নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনাগুলো ঘটে আর প্রাণ হারায় নিরীহ সাধারণ মানুষ। তাই সাধারণ মানুষ ভোট দেয়ার সাহসটুকু হারিয়ে ফেলেছে। কাজেই নির্বাচনী সহিংসতায় যেসব মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং মানুষ যে এখন ভোট দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে এর দায় নির্বাচন কমিশন কোনোমতে এড়াতে পারে না।’

তাই নির্বাচন দেয়ার আগে নির্বাচন কমিশনকে প্রত্যেকটি ভোট কেন্দ্রে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে বলে জানান তিনি।

এ বিভাগের আরো খবর