নওগাঁর পত্নীতলায় কাদিয়াল সিদ্দিকিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার, সভাপতি ও শরীর চর্চার শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্বেচ্ছাচারিতা, ‘ভুয়া’ কমিটি গঠনের মাধ্যমে বেতন উত্তোলন, পাঁচটি পদে নিয়োগের নামে ৭০ লাখ টাকার নিয়োগ বাণিজ্য, একজনের কাছে থেকে ১০ লাখ টাকার প্রতারণা, সহকারী শিক্ষকে কারণ দর্শনার নোটিশ ছাড়াই শোকজসহ নানা অভিযোগ তুলেছেন মাদ্রাসা কমিটির সাবেক সদস্য আবদুল মতিন ও মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক আবদুল মুত্তালিব।
অনিয়ম নিয়ে প্রতিবাদ করায় কমিটির সাবেক সদস্য ও সহকারী শিক্ষকে হয়রানি করারও অভিযোগও পাওয়া গেছে।
অভিযোগ সূত্র ও সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, মাদ্রাসা সুপার নওশাদ আলম কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার এই কাজে সহযোগিতা করেছেন প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি শহিদুল ইসলাম এবং শরীর চর্চার শিক্ষক আসলাম আলী।
২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবরে গঠিত দুই বছরের জন্য নির্বাচিত ১১ সদস্যবিশিষ্ট মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠিত হয়। কমিটি বহাল থাকা অবস্থায় পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়ে সর্বশেষ ২০২২ সালের মে মাসে একটি কমিটি গঠন করেন মাদ্রাসা সুপার নওশাদ আলম। কমিটির সভাপতি করা হয় তার পছন্দের ব্যক্তি শহিদুল ইসলামকে।
২০১৮ সালের এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী মাদ্রাসা সুপার নওশাদ আলী ২০২০ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচটি পদে নিয়োগ দেয় পাঁচজনকে।
নিয়োগপ্রাপ্তরা হলেন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর পদে রাশেদ হোসেন, আয়া পদে সুলতানা বেগম, গ্রন্থাগারিক রাবেয়া খাতুন, দপ্তরি কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে আলমগীর হোসেন এবং নিরাপত্তা প্রহরী আবু সালেহ।
এই পাঁচটি পদে মোট ৬০ লাখ টাকার নিয়োগ বাণিজ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া পরিচ্ছন্নতা কর্মী পদে স্থানীয় আবু রায়হান নামের এক ব্যক্তির কাছে নিয়োগের কথা বলে দুই দফায় ১০ লাখ নিয়ে নিয়োগপত্র দেয়ার পরও রাশেদ হোসেনের কাছে থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়ে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়।
মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক আবদুল মুত্তালিব এসব তথ্য দিয়ে বলেন, ‘অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করতে গেলে আমাকে কোনো পূর্ব নোটিশ ছাড়াই নিয়ম বহির্ভূতভাবে বরখাস্ত করা হয়।’
চলমান অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মাদ্রাসা বোর্ড, জেলা ও উপজেলা শিক্ষাবোর্ড এবং ইউএনও বরাবর অভিযোগ করেন মাদ্রাসা কমিটির সাবেক সদস্য আবদুল মতিন।
তিনি বলেন, ‘২০১৮ থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচটি পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রায় ৬০ লাখ টাকার নিয়োগ বাণিজ্য হয়েছে। পুরো টাকা মাদ্রাসা সুপার নওশাদ আলম, সভাপতি শহিদুল ইসলাম ও শরীর চর্চার শিক্ষক আসলাম আলী তাদের পকেটে ঢুকিয়েছেন। নিয়োগের নামে আবু রায়হানের কাছে থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়েও তাকে নিয়োগ দেয়া হয়নি।
‘প্রতিবাদ করতে গেলে আমাদের নানা ভাবে মিথ্যা মামলা ও হয়রানি করা হয়। যদিও মামলার সত্যতা প্রমাণ হয়নি। বিভিন্ন দপ্তরে প্রতিকার ও ব্যবস্থা গ্রহণ চেয়ে অভিযোগ দিয়েছি। অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে শুনেছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, আগের মতন আর শিক্ষার পরিবেশ নেই। অনেক শিক্ষার্থী কমে গেছে। নিরাপত্তা প্রহরীকে দিয়েও অনেক সময় ক্লাস করানো হয়।
স্থানীয় আবু রায়হান বলেন, ‘দুই দফায় ১০ লাখ টাকা নিয়ে একটি নিয়োগপত্র দেয়। পরবর্তী সময়ে রাশেদ নামের একজনকে পরিচ্ছন্নতা কর্মী পদে নিয়োগ দেয়া হয়। টাকা ফেরত চাইলে গেলে তারা আমাকে নানাভাবে হুমকি-ধামকি দিয়ে হয়রানি করছে। আমি এর প্রতিকার চাই।’
সভাপতি শহিদুল ইসলামের ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মাদ্রাসার চারবারের সাবেক সভাপতি ও স্থানীয় আমাইড় ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রকিব বলেন, ‘সর্বশেষ ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত আমি সভাপতি ছিলাম। নিয়োগ বাণিজ্যের প্রতিবাদও করেছিলাম। আমাকে অর্থ দিয়ে চুপ রাখতে চেয়েছিল তারা। তাদের লাগামহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের সুষ্ঠু সুহারার দাবি জানাচ্ছি।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসার শরীর চর্চার শিক্ষক আসলাম আলী বলেন, ‘আপনি কে আমাকে প্রশ্ন করার? আর কেনই বা ফোন দিয়েছেন আমাকে?’
‘আপনার মতো অনেক সাংবাদিক আমার পরিচিত আছে’ বলেই ফোনের সংযোগ কেটে দেন তিনি।
মাদ্রাসা সুপার নওশাদ আলম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে সব অভিযোগগুলো সঠিক নয়, সঠিক নিয়মেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়োগের নামে টাকা নিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়নি, এটা সঠিক নয়। যিনি অভিযোগ করেছেন সেটা ভুয়া নিয়োগপত্র। আসেন দেখা করেন; কথা হবে। সব কথা তো আর ফোনে বলা যায় না।’
পত্নীতলা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার জিল্লুর রহমান বলেন, ‘মাদ্রাসা বোর্ডসহ বিভিন্ন দপ্তরে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়েছে, তবে ঊর্ধ্বতন দপ্তর থেকে আমাদের কোনো চিঠি দেয়া হয়নি। কোনো শিক্ষককে স্থানীয় বরখাস্তের এখতিয়ার মাদ্রাসা সুপার বা কমিটির নাই।
‘তারা রেজুলেশন করে অভিযোগ করতে পারেন ঊর্ধ্বতন দপ্তরে। অভিযোগ প্রমাণিত না হলে ওই শিক্ষক স্বপদে বহাল থাকবেন। মাদ্রাসার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএন) রুমানা আফরোজ বলেন, ‘মাদ্রাসাটির বিষয়ে বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। মাদ্রাসা বোর্ড থেকে তদন্ত করার জন্য বলা হয়। কয়েকদিন পূর্ব তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন প্রতিবেদন অনুযায়ী বোর্ড পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।’