কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে বহুল প্রতীক্ষিত দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রথম টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। এখানে বাণিজ্যিক এবং এনার্জি হাব তৈরিরও পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার বিকেলে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর চ্যানেল উদ্বোধন এবং প্রথম টার্মিনালের ভিত্তি স্থাপন করেন। এর মধ্য দিয়ে মাতারবাড়ী ঘিরে অর্থনৈতিক অগ্রগতির নতুন স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে হাঁটা শুরু করল বাংলাদেশ।
মাতারবাড়ী বন্দরের প্রথম প্রকল্প পরিচালক জাফর আলম বলেন, ‘আজ (শনিবার) আমাদের জন্য আনন্দের দিন। বাংলাদেশের জন্য গভীর সমুদ্র বন্দর প্রয়োজন ছিল। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ কাজ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে মেরিটাইম বিশ্বে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী।’
মাতারবাড়ীর যেখানে এখন কয়লা জেটি হয়েছে সেটি ১০ মিটার নিচে ছিল। অনেক চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে এখন মাতারবাড়ী চ্যানেল শুধু দৃশ্যমান নয়, শতাধিক জাহাজও সফলভাবে ভিড়েছে।
শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আরিফ বলেন, ‘মেরিটাইম বিশ্বে নতুন দিগন্ত মাতারবাড়ী। ২০২৬ সালের পর বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানিকারকদের আর ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট ব্যবহার করতে হবে না। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে সরাসরি বড় জাহাজ ভিড়বে মাতারবাড়ী জেটিতে। তাতে করে সময় এবং ব্যয় দুই-ই কমে যাবে।’
চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, ‘মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর আমাদের স্বপ্নের প্রজেক্ট। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশের প্রথম ব্রেক ওয়াটারের মাধ্যমে নীল জলরাশির চ্যানেল আজ দৃশ্যমান।
‘এই চ্যানেল দিয়ে কয়লা বোঝাই বড় বড় সব জাহাজ জেটিতে আসা-যাওয়া করে রেকর্ড করেছে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা আজ প্রথম টার্মিনালের ভিত্তি স্থাপন করলেন। এখন আমাদের চাওয়া, টার্মিনালটি দ্রুত তৈরি হোক।’
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম, মোংলা এবং পায়রা বন্দরের কর্মচাঞ্চল্যও বেড়ে যাবে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরের কারণে। এই বন্দরের কল্যাণে সংশ্লিষ্ট পুরো অঞ্চলে অর্থনৈতিক ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে।’
চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি ওমর হাজ্জাজ বলেন, ‘গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে দেশের আমদানি-রপ্তানি ব্যয় ও সময় দুই-ই কমবে। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখানে আরও বেশি করে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন।
‘এ ছাড়া গভীর সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে বাণিজ্যিক ও এনার্জি হাব প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পরিণত হচ্ছে মাতারবাড়ী।’
দেশের আমদানি-রপ্তানি গতিশীল এবং ব্যয় কমাতে মহেশখালীতে প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০২৬ সালে এই বন্দর পুরোদমে চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
গভীর সমুদ্রবন্দরে থাকবে একটি ৩০০ মিটার দীর্ঘ মাল্টিপারপাস জেটি, একটি ৪৬০ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার জাহাজ বার্থিং জেটি। থাকবে তিনটি টাগ বোট, একটি পাইলট বোট, একটি সার্ভে বোটসহ কার্গো হ্যান্ডলিং ইক্যুইপমেন্ট টিওএস অ্যান্ড সিকিউরিটি সিস্টেম।
গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে জাতীয় মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক। একে কেন্দ্র করে মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে বাণিজ্যিক হাব তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ওই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অত্র অঞ্চলে উন্নত যোগাযোগ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগ আনা হচ্ছে।
মাতারবাড়ীকে ‘এনার্জি হাব’ হিসেবে গড়ে তুলতে এলএনজি টার্মিনাল, এলপিজি টার্মিনাল, অয়েল টার্মিনাল, গ্যাস ট্রান্সমিশন এবং সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।
‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব’ হিসেবে গড়ে তুলতে অয়েল রিফাইনারি, এনার্জি ও ফুড স্টোরেজ, ট্যুরিজম, অ্যামব্যাঙ্কমেন্ট ও ওয়াটারফ্রন্ট ইকনোমিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজও চলছে।
মাতারবাড়ীর সঙ্গে দেশ-বিদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপ দেয়া হয়েছে। সম্প্রসারণ প্রকল্পটি চলতি বছরেই শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। পর্যটন নগরী ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
দেশের প্রথম ও একমাত্র গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনের জন্য ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা প্রাক্বলিত ব্যয়ে মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
জাইকা, সরকার ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের ৮ হাজার ৯৫৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা ও সওজের ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা রয়েছে।
গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে ৩৫০ মিটার প্রশস্ত ও ১৬ মিটার গভীরতাসম্পন্ন ১৪ দশমিক ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ চ্যানেলের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। অ্যাপ্রোচ চ্যানেলের উত্তর পাশে ২ হাজার ১৫০ মিটার ও দক্ষিণ পাশে ৬৭০ মিটার দীর্ঘ ব্রেক ওয়াটার (ঢেউ নিরোধক বাঁধ) নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।
২০২৬ সালের মধ্যে আনুমানিক দশমিক ৬ থেকে ১ দশমিক ১ মিলিয়ন টিইইউস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কনটেইনার) এবং ২০৪১ সালের মধ্যে আনুমানিক ২ দশমিক ২ থেকে ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন টিইইউস কন্টেইনার কার্গো হ্যান্ডেল করা সম্ভব হবে।
প্রকল্পের সড়ক ও জনপথ অংশে ২৭ দশমিক ৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে মাতারবাড়ী বন্দরের সঙ্গে ন্যাশনাল হাইওয়ের সংযোগ স্থাপন করার কাজ চলছে।
মাতারবাড়ী বন্দরকে ঘিরে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ আবর্তিত হবে তা বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা জিডিপিতে ২ থেকে ৩ শতাংশ অবদান রাখবে।