দীর্ঘ প্রতীক্ষার পালা শেষে কক্সবাজারবাসীর তথা সারা দেশের ভ্রমণ পিপাসুদের স্বপ্নপূরণ হল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করলেন দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। রেল নেটওয়ার্কে ৪৮তম জেলা হিসেবে যুক্ত হল পর্যটন নগরী কক্সবাজার।
শনিবার সকালে এই রেলপথ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তিনি বলেন, ‘আজকে কক্সবাজার রেল যোগাযোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই দিনটি গর্বিত হওয়ার দিন। দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকতে পেরে সত্যিই খুব খুশি হয়েছি। আমি রেলপথ উদ্বোধন করে আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি। এটা এ অঞ্চলের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। আজ সেই দাবি পূরণ হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘পঞ্চগড় থেকে কক্সবাজার অথবা রাজশাহী থেকে কক্সবাজার, দক্ষিণাঞ্চল সুন্দরবন থেকে কক্সবাজার, এমনকি গোপালগঞ্জ-ফরিদপুর অর্থাৎ সমগ্র বাংলাদেশ থেকেই যাতে সহজে কক্সবাজার আসা যায় সেই পদক্ষেপও আমরা দ্রুতই নেব। এই যোগাযোগগুলো সম্পন্ন হলে আমাদের পর্যটনের ক্ষেত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই প্রকল্প বাস্তায়নের সময় ৩৯টি মেজর ব্রিজ করতে হয়েছে। ২৪৪টি ছোট ও মাঝারি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ৯টি স্টেশন ও আধুনিক কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সিগনালিং ব্যবস্থা ইনস্টল করা হয়েছে। একটি ওভারপাস ও দুটি আন্ডারপাস ও নির্মাণ করা হয়েছে। এই রেললাইনটা চকোরিয়া থেকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও পাওয়ার প্লান্ট এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে যাতে সংযুক্ত হয় তার ব্যবস্থাও আমরা করে দেব। যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও উন্নত হয় তাই আমার সরকারের এ চেষ্টা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সরকার ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মিলে সম্প্রতি খুলনা থেকে মোংলা পোর্ট পর্যন্ত ব্রডগেজ রেল চলাচলের উদ্বোধন করেছে। যে লাইনটা এক সময় খালেদা জিয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি ঢাকা-টঙ্গি-গাজীপুর ডুয়েল গেজ লাইনও নির্মাণ করা হচ্ছে। রেলের যাত্রীসেবা ও পণ্য পরিবহনের মানোন্নয়নে আরও ৪৬টি নতুন ব্রডগেজ লোকামোটিভ, ৪৬০টি নতুন যাত্রীবাহী ক্যারেজ, ২০০টি নতুন মিটার গেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজ, ১৩১০টি নতুন ওয়াগন সরবারহের উদ্যোগও সরকার হাতে নিয়েছে।
‘আগামী ৩ থেকে ৪ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাতে উন্নীত হয় সেই পদক্ষেপই আমরা নিয়েছি এবং সেটা আমরা বাস্তবায়ন করব।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় রেল সচিব হুমায়ুন কবির বলেন, ‘কক্সবাজারের সঙ্গে শুধু ঢাকা নয়, পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গেও এ রেলপথ যুক্ত করা হবে।’
এ সময় রেল সচিব আরও বলেন, ‘পরবর্তীতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরও সংযুক্ত হবে এ প্রকল্পের সঙ্গে। একই সঙ্গে বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমের জন্যে এ প্রকল্পের আওতায় ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়েছে ইতোমধ্যে।’
জানা গেছে, বৃটিশ-পাকিস্তান পিরিয়ড ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের স্বপ্ন ছিল দেশের সর্বদক্ষিণ জেলা কক্সবাজারের সঙ্গে সরাসরি রেল সংযোগ। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বহু সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। কিন্তু কোনো সরকারই কক্সবাজারে রেল সংযোগের বিষয়ে মাথা ঘামায়নি। তবে, ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরই রেল সংযোগে সারাদেশের সঙ্গে কক্সবাজারকে যুক্ত করতে প্রকল্প হাতে নেয় আওয়ামী লীগ।
সেই প্রকল্পের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের আইকনিক রেলস্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে পর্যটন শহর কক্সবাজারে। এই স্টেশনে রয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত সব ধরনের ব্যবস্থা। শুধু রেল যোগাযোগের জন্য নয়, পর্যটনের নতুন অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচ্য হচ্ছে দেশের একমাত্র আইকনিক এই রেলস্টেশন। এমনটি অভিমত কক্সবাজারের সচেতন মহলের।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন বলেন, ‘ছয়তলার এই স্টেশনে রয়েছে চলন্ত সিঁড়ি, মালামাল রাখার লকার, হোটেল, রেস্তোরাঁ, শপিংমলসহ আধুনিক সব সুবিধা। ৪৬ হাজার মানুষের ধারণ ক্ষমতা সম্বলিত স্টেশনটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এতে আছে কনভেনশন হল, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথ, এটিএম বুথ, এমনকি প্রার্থনার স্থানও। স্টেশনে ফুড কোর্ট, হোটেল ও শপিং কমপ্লেক্সের বিষয়টি বাইরের এজেন্সি দ্বারা টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে।’
ভবন ও আশপাশের রেলপথ নির্মাণ কাজের প্রকৌশলী এনামুল হক সরকার এনাম বলেন, ‘অবকাঠামোসহ আইকনিক স্টেশন ভবন পর্যটক বরণে পুরোপুরী প্রস্তুত। সামগ্রিকভাবে প্রায় ৯২ শতাংশ কাজ শেষ। রেলপথের সক্ষমতা যাচাইয়ে ৫ নভেম্বর পরিদর্শন রেল এসে ঘুরে গেছে। ১ ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিকভাবে কক্সবাজারে রেল যোগাযোগ শুরু করা যাবে। তবে কার্যাদেশ অনুসারে চলতি অর্থবছরের শেষসময়ে কাজ পুরোপুরি বুঝিয়ে দেয়া হবে।’
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘রেলপথ-আইকনিক স্টেশন, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর এবং তাপ-বিদ্যুত কেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে কক্সবাজারে শিল্প উদ্যোক্তা বাড়বে। যোগাযোগ সহজতর হলে সমৃদ্ধ হবে পর্যটনও।’
দোহাজারী-কক্সবাজার ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১০ শুরু হয়ে ২০১৩ সালে শেষ হবার কথা ছিল। তবে, ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল একনেকে অনুমোদিত হয় এবং এ লাইনে ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। কিন্তু জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ২০১৬ সালে সংশোধিত প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকায়। এই বাজেটে এডিবি ঋণ দেয় ১৩ হাজার ১১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা আর বাকি চার হাজার ৯১৯ কোটি সাত লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে।
একনেক অনুমোদনের পর, প্রকল্পের মেয়াদকাল ২০১০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন ধরা হয়। এ রেলপথ নির্মাণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় এক হাজার ৩৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে ঠিকাদারকে বুঝিয়ে দিতে বিলম্ব হয়।
প্রকল্পের ১৬৫ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল ডি-রিজার্ভকরণসহ প্রকল্পে ব্যবহারে অনুমতি পেতে কালক্ষেপণ হয়। ২০১৯ সালের শেষাংশে শুরু হয় সংরক্ষিত বনাঞ্চলভুক্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকার গাছপালা কাটা ও ভৌত কাজ। পিজিসিবি, বিপিডিবি ও বিআইবির বৈদ্যুতিক টাওয়ার ও পোল স্থানান্তরে চারদফা বৈঠক হয় আন্তঃমন্ত্রণালয়ে। এসবের সঙ্গে যোগ হয় করোনা মহামারি। ২০২০ সালে প্রায় দেড়মাস বন্ধ থাকায় প্রকল্পের কাজে বিঘ্ন ঘটে। বিশ্বব্যাপী লকডাউনের কারণে আমদানিকৃত বিভিন্ন মালামাল সঠিক সময়ে দেশে এসে পৌঁছেনি। এ পরিপ্রেক্ষিতে সবকাজ শেষ হতে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এই সময়ের আগেই আজ ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার রেলপথ ও আইকনিক রেল স্টেশন উদ্বোধন করবেন।