পাঁচ বছর ধরে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা সংক্রান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানির তারিখ পিছিয়ে আগামী ১৬ নভেম্বর দিন ঠিক করে দিয়েছে আপিল বিভাগ।
রিটকারীর পক্ষে সময় আবেদন করায় বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ পাচঁ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ দিন ঠিক করে দেয়।
সময় প্রার্থনা করেন আইনজীবী এম আশরাফুজ্জামান খান। পরে তিনি বলেন, সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বৃহস্পতিবার আদালতে উপস্থিত হতে পারেননি, এ কারণে সময় চাওয়া হয়েছে। আদালত পিছিয়ে আগামী ১৬ নভেম্বর দিন ঠিক করে দিয়েছে। ওই দিন মামলাটি আপিল বিভাগের তালিকায় শীর্ষে থাকবে।
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নেয়া সংক্রান্ত বহুল আলোচিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেয়া রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য সর্বোচ্চ আদালতে ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদনটি করে রাষ্ট্রপক্ষ। রায় পুনর্বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের ৯৪টি সুনির্দিষ্ট যুক্তি তুলে ধরে ৯০৮ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে পুরো রায়টি বাতিল চাওয়া হয়।
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। ২২ সেপ্টেম্বর এর গেজেট হয়। এরপর ওই ষোড়শ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট করেন। পরে ৯ নভেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ওই রিটে রুল জারি করে।
এরপর ২০১৬ সালের ৫ মে তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠমতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান-পরিপন্থী বলে রায় ঘোষণা করে। একই বছরের ১১ আগস্ট তার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের শুনানি নিয়ে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ।
এরপর ওই বছরের ১ আগস্ট ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, সংসদসহ বিভিন্ন ইস্যুতে পর্যবেক্ষণ রাখা হয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে খাটো করা হয়েছে অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবিতে সরব হয়ে ওঠেন সরকারি দলীয় আইনজীবীরা।
জাতীয় সংসদেও এ রায় ও প্রধান বিচারপতির অনেক সমালোচনা করা হয়। এরপর ওই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর সংসদে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আইনি পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। তারই প্রেক্ষাপটে রিভিউ আবেদন করা হয়।
এ রায় নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ২০১৭ সালের ৩ অক্টোবর ছুটিতে যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পরে ১৩ অক্টোবর তিনি বিদেশে চলে যান। ১০ নভেম্বর তিনি সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর নিজের পদত্যাগ পত্র জমা দেন।
যে যুক্তিতে রিভিউ করা হয়, সংবিধানের তফসিলে সন্নিবেশিত ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল প্রণীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ উল্লেখ করে রিভিউ আবেদনে বলা হয়েছে, একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের ফাউন্ডিং ফাদার রূপে স্বীকৃত। আপিল বিভাগ ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’ বহুবচন শব্দ ব্যবহার করে ভুল করেছেন। তাই এর পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন। রায়ের একটি অংশে পর্যবেক্ষণে ‘আমিত্ব’ ধারণা থেকে মুক্তি পেতে হবে বলে যা উল্লেখ আছে, সে প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউ আবেদনে যুক্তি দেখিয়ে বলছে, আদালতের এই পর্যবেক্ষণ ভিত্তিহীন ও অপ্রত্যাশিত। যা আমাদের এই মামলার বিবেচ্য বিষয় নয়। এটি সংশোধনযোগ্য।
ষোড়শ সংশোধনীর আপিলের রায়ের আরেকটি পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ১. আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও সংসদ এখনও শিশুসুলভ ২. এখনও এই দুটি প্রতিষ্ঠান মানুষের আস্থাঅর্জন করতে পারেনি। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, এই পর্যবেক্ষণ আদালতের বিচার্য বিষয় নয়। বিচারিক শিষ্টাচারের বাইরে গিয়ে এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যা সংশোধনযোগ্য।
ষোড়শ সংশোধনীর আপিলের রায়ের আরেকটি পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সংসদীয় গণতন্ত্র অপরিপক্ষ। যদি সংসদের হাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয় তবে তা হবে আত্মঘাতী।
এর সুরাহা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আদালতের এই পর্যবেক্ষণ শুধু অবমাননাকরই নয়, বরং ভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্ন। আদালতের বিচারিক এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে এই মন্তব্য করা হয়েছে। রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ অন্য একটি অঙ্গের বিরুদ্ধে এরূপ মন্তব্য করতে পারে না। এটা বিচারিক মন্তব্য নয়, এ মন্তব্য করে আদালত ভুল করেছে, যা সংশোধনযোগ্য ও বাতিলযোগ্য।