দুটি ফসলের মাঠকে বিভক্ত করেছে মেঠোপথের সরু রাস্তা। বিস্তীর্ণ মাঠের চারদিকে সবুজের সমারোহ। এর মধ্যে গড়ে উঠেছে ইটভাটা।
এ চিত্র চোখে পড়বে নওগাঁর বদলগাছীতে। এখানে ইটভাটার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি উপজেলার মিঠাপুর ও পাহাড়পুর ইউনিয়নে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলায় ২৪ থেকে ২৬টি ইটভাটা রয়েছে। উপজেলার মিঠাপুর ইউনিয়নের সরাইবাড়ী বুড়িগঞ্জ নামক স্থানে আদিল ব্রিক্স ও এমবিএফ ব্রিক্স দুটি পাশাপাশি। একেবারে রাস্তার এপার আর ওপার।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, বিশেষ কোনো স্থাপনা, রেলপথ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা অনুরূপ কোনো স্থান বা প্রতিষ্ঠান হতে কমপক্ষে ১ (এক) কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে কোনো ইটভাটা স্থাপনের নিয়ম নেই।
ইটভাটার কয়েকজন মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবাসিক এলাকা থেকে এক কিলোমিটার দূরে ইটভাটা স্থাপনের নিয়ম থাকলেও বেশির ভাগ ইটভাটা স্থাপনে মানা হয়নি কোনো নিয়ম। আবার প্রতিটি চিমনি নির্দিষ্ট করে উঁচু করার কথা থাকলেও অনেকেই খরচের অজুহাতে তা বানান নি। এ ছাড়া প্রায় প্রতিটি ইটভাটায় মজুত করা হয়েছে জ্বালানি কাঠ। যা ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হবে বলে জানান মালিকরা।
আগুন দেয়ার পর ভাটা থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়বে কাঠ পোড়ানোর কালো ধোঁয়া।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, এ কালো ধোয়ার ফলে ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা হারাবে জমি। নষ্ট হয় বিভিন্ন ফল ও ফসল।
স্থানীয়রা জানায়, অনুৎপাদনশীল জমি বিবেচনায় না নিয়ে ফসলি জমিতে ইটভাটা গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে বিঘায় বিঘায় ফসলি জমি উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে। কারণ, ইট তৈরিতে পাশের জমি থেকে মাটি তুলে নেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে ইটভাটা এলাকায় বানানো চুলার আগুন অন্য জমিকে উত্তপ্ত করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘ভাটা যখন চালু করে তখন কালো ধোঁয়া ও ধুলাবালুতে বাড়িঘরে থাকা যায় না। জমির ফসল জমিতেই নষ্ট হয়। এভাবে চলতে থাকলে ভাটার চারদিকের জমিগুলো একসময় অনাবাদি হয়ে পড়বে। ভাটার মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় এলাকার লোকজন প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না।’
এদিকে একটি ইটভাটা একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে পরবর্তী ইটভাটা নির্মাণের বিধান থাকলেও পাশাপাশি গড়ে তোলা হয়েছে ইটভাটা। সরেজমিনে গিয়ে এমনটাই চোখে পড়ে।
একটি ইটভাটা থাকতে পাশাপাশি আরেকটা করা যায় কি না জানতে চাইলে আদিল ব্রিক্সের ম্যানেজার রাব্বি বলেন, ‘অবশ্যই করা যায়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করব সেখানে নিয়ম কী! আমাদেরটা তো পাশাপাশি।
‘এখানে একসঙ্গে লাগানো ইটভাটাও আছে। আমরা প্রায় ১৪ বছর ধরে এভাবেই ব্যবসা করে যাচ্ছি।’
পাশাপাশি একটি এমবিএফ ইটভাটার স্বত্বাধিকারী মো. হাসু বলেন, ‘আমার ইটভাটা আগে করা। এরকম প্রায় সব জায়গাতেই আছে।’ তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের সনদ নেই বলে জানালেন তিনি।
একটু দূরে একই নামে তাদের আরেকটি ইটভাটা আছে। কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানো হবে কি না জানতে চাইলে ওই ইটভাটার স্বত্বাধিকারী আরেক ভাই শামীম বলেন, ‘আগুন দিতে যে খড়িগুলো লাগে সেগুলো আমি নিয়ে এসেছি।’
বদলগাছী উপজেলার ইটভাটা সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ বলেন, ‘আমার কিছু বলার নাই ভাই। কারণ যার টাকা হচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠান করছে। যে আইন লঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠান করেছে এখন তারই দায়িত্ব নিতে হবে।’
কেউ ইটভাটা করতে চাইলে তাদেরকে নিয়ম সম্পর্কে অবগত করেন কি না প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি দায়িত্বে আসার পর মাত্র এক থেকে দুইটা ইটভাটা হয়েছে। এ ছাড়া আমি দায়িত্ব নেয়ার পর আরও তিন থেকে চারটা ইটভাটা করতে চেয়েছিল। ইউএনও মহোদয়কে বলে আমি সেগুলো বন্ধ করিয়েছি। তবে বদলগাছী উপজেলায় কারো পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। আমারসহ দু-চারজনের ছিল। ২০ সালের পর সেগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে।
‘রাস্তায় মাটি ফেলার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও ইউএনও আমাদের সবসময় চাপে রাখে। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
পাশাপাশি ইটভাটা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই দুটো অনেক আগেই করা হয়েছে। তখন এরকম নিয়ম ছিল না। ২০১২ কি ১৪ সালের পর নিয়মগুলো চালু হয়েছে।’
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলপনা ইয়াসমিন ফোনে বলেন, ‘ইটভাটার প্রতিবেদনের বিষয়ে সাক্ষাৎকার নিতে হলে অফিসে এসে নিতে হবে।’
মোবাইলে সহযোগিতা করতে পারছেন না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত জানিয়ে সংযোগটি কেটে দেন তিনি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মলিন মিয়া বলেন, ‘জেলার সব ইটভাটার মালিককে ডাকা হয়েছে। বুধবার তাদেরকে নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে মতবিনিময় সভা করব। সেখানে স্পষ্ট করে আইনের নিয়ম কানুন তাদেরকে বলে দেব।’
আর আইন মেনে কেউ আবেদন করলে তাকে পরিবেশ সনদ দেয়া হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।