বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লিতে সহিংসতার বিচার হয়নি ৭ বছরেও

  •    
  • ৬ নভেম্বর, ২০২৩ ১১:৩০

এখনও পর্যন্ত মামলাটির দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকা আর প্রধান অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষুব্ধ সাঁওতাল নেতাসহ নিহত-আহতের পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্তরা। তবে মামলার এ দীর্ঘসূত্রিতার পেছনে মামলার বাদীর বারবার নারাজিকেই দূষছে রাষ্ট্রপক্ষ।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লিতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও তিন সাঁওতালকে হত্যার সাত বছরেও হয়নি বিচার। এ ঘটনায় হওয়া মামলায় পিবিআইয়ের তদন্তের নারাজির পর সিআইডির তদন্ত শেষে চার্জশিট জমা হয়েছে আদালতে।

এখনও পর্যন্ত মামলাটির দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকা আর প্রধান অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষুব্ধ সাঁওতাল নেতাসহ নিহত-আহতের পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্তরা। তবে মামলার এ দীর্ঘসূত্রিতার পেছনে মামলার বাদীর বারবার নারাজিকেই দূষছে রাষ্ট্রপক্ষ।

সাত বছর ধরে ৬ নভেম্বর প্রতি বছর ‘সাঁওতাল হত্যা’ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে স্থানীয়রা সাঁওতালরা। দিবসটি উপলক্ষে সোমবার সকালে গোবিন্দগঞ্জের নিহত তিন সাঁওতালের অস্থায়ী বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। বেলা ১১ টার দিকে বিক্ষোভ শেষে উপজেলায় কাটাবাড়ি মোড়ে সমাবেশ হবে তাদের। সেখানে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের শীর্ষ সাঁওতাল নেতাদের বক্তব্য দেয়ার কথা রয়েছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৫৪ সালে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জের রংপুর সুগার মিলস লিমিটেড আখ চাষের জন্য সাপমারা ও কাটাবাড়ী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের এক হাজার ৮'৪২ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে রংপুর চিনিকল।

৭৩ শতাংশ মুসলমান আর ২৭ শতাংশ সাঁওতালদের জমি অধিগ্রহণের পর ‘সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম’ নামে নামকরণ করা হয়। এর কয়েক বছর পর অধিগ্রহণ করা জমি মিল কর্তৃপক্ষের কাছে ইজারা নিয়ে ধান, পাট ও তামাকসহ বিভিন্ন আবাদ করে আসছিল সাঁওতালরা।

পরে ২০০২ সালে অধিগ্রহণ চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ এনে বাপ-দাদার জমি ফেরত চেয়ে আন্দোলন শুরু করেন সাঁওতালরা। আর ২০১৪ সালে তারা গঠন করে ‘সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি’।

এরপর চলতে থাকে সাঁওতাল-বাঙালিদের ভূমি উদ্ধারের মানববন্ধন, মিছিল-মিটিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচি। ২০১৬ সালের ১ জুলাই সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের প্রায় ১০০ একর জমিতে ঝুঁপড়ি ঘর নির্মাণ করে বসবাস আর জমিতে চাষাবাদ শুরু করে সাঁওতাল-বাঙালিরা। বাকি জমিতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ রোপণ করে।

পরে হঠাৎ কোনো নোটিশ ছাড়াই ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সকালে আখ কাটা নিয়ে পুলিশসহ চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ বাধে। এতে চারজন সাঁওতাল গুলিবিদ্ধ হলেও শ্যামল হেমরম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু নামে তিনজন নিহত ও উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হন।

অভিযোগ রয়েছে, পরে ওই দিন সন্ধ্যার দিকেই ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করা হয়। এতে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের হাত আছে বলে দাবি করা হয় কয়েকটি ভিডিওর বরাতে।

হামলার ঘটনায় সাঁওতালদের পক্ষে থমাস হেমব্রম ওই বছরের ২৬ নভেম্বর তৎকালীন গাইবান্ধা- ৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আওয়াল, তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আব্দুল হান্নান, খামারের ব্যবস্থাপক আব্দুল মজিদ, সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুল ও কাটাবারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রফিকসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে পুলিশসহ ৫'শ-৬'শ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় ২৫ আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। উদ্ধার করা হয় লুট করা একটি পাওয়ার টিলার, দুটি শ্যালো মেশিন, একটি ভ্যান ও ৫৬টি ঢেউটিন। আসামিদের মধ্যে গোবিন্দগঞ্জের সারাই গ্রামের শাহজাহান আলীর ছেলে মিঠু মিয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন আদালতে।

তদন্ত শেষে পিবিআই ৯০ জনকে আসামি করে ২০১৯ সালের ২৮ জুন গোবিন্দগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিলেও প্রধান আসামি এমপি আবুল কালাম আজাদসহ প্রকৃত দোষীদের বাদ দেয়ার অভিযোগ এনে সেই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর আদালতে নারাজি পিটিশন করেন মামলার বাদী থমাস হেমব্রম।

পরে সেটি নারাজি পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডিকে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ২ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৪৯৬ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি।

এতে মামলার মূল আসামিদের নাম আবারও বাদ দিয়ে চার্জশিট দেয়ার অভিযোগ তুলে সেটিও প্রত্যাখ্যান করে ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি আবারও সিআইডির প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দেন মামলার বাদী থমাস হেমব্রম।

ওই নারাজি পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি একই বছরের ৭ ডিসেম্বর শুনানি ও আলোচনা হয় আদালতে। এর পর তিন দফায় শুনানি পিছিয়ে ২০২৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি এবং পরে একই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর নারাজি শুনানির দিন ধার্য করে আদালত। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১২ মার্চ নারাজি শুনানির পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে আদালতে।

এদিকে হামলার অভিযোগে সাঁওতাল-বাঙালিদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশও। সেই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেছে পিবিআই। প্রতিবেদনে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলীসহ ৪২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই মামলার তিনজন অভিযুক্ত ইতোমধ্যে মারা গেছেন।

জানা গেছে, বিরোধপূর্ণ ওই সব জমিতে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালেন ২৪ আগস্ট ইপিজেড বাস্তবায়নে রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল নজরুল ইসলাম।

এদিকে সাঁওতালদের জমি ফেরতের আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে একাত্বতা জানিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশ রবিদাস ফোরাম এবং গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চ, সাকোঁয়া ব্রীজ ইপিজেড বাস্তবায়ন মঞ্চ, আদিবাসি-বাঙ্গালি সংহতি পরিষদ, আদিবাসি ইউনিয়ন ও জনউদ্যোগের মতো রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন।

সাঁওতাল হত্যা মামলার বাদী থমাস হেব্রম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সারা পৃথিবীর গণমাধ্যমে প্রকাশিত আগুন লাগানোর ফুটেজ, ছবি প্রকাশ পেলেও এখন পর্যন্ত কোনো সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। মূল আসামিদের বাদ দিয়ে প্রথমবার পিবিআই চার্জশিট দেয়। পরে নারাজি করলে সিআইডিকে তদন্তভার দেয় আদালত। কিন্তু সিআইডিও ঘটনার সঙ্গে জড়িত মূল আসামিদের নাম বাদ দিয়ে পিবিআইয়ের পথেই হেঁটে চার্জশিট জমা দেয়। পরে আমি এই প্রতিবদেনও প্রত্যাখ্যান করে নারাজি করেছি।

‘সাত বছরেও মামলাটির দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। সুষ্ঠু বিচার না পেলে আরও জোরালো আন্দোলন করা হবে। আমাদের বাপ-দাদার জমিতে ইপিজেড করতে চাচ্ছে, তা আমরা হতে দেব না। দরকার হলে তিন ভাইয়ের মতো আমরাও জীবন দেব, তবুও জমিতে একটা ইট পুঁততে দেব না।’

সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাসকে বলেন, ‘এই বিচারহীনতা প্রমাণ করে জাতিগত সংখ্যালঘু সাওতালদের কতটা অবহেলার চোখে দেখা হয়। যে দেশ সাঁওতাল-বাঙ্গালিরা যুদ্ধ করে জীবন আর রক্ত দিয়ে স্বাধীন করল, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে তারাই আজ নিজ ভূমি হতে উচ্ছেদ হয়েছে। শুধু তাইনা, সেই ভূমি উদ্ধার করতে গিয়ে জীবন দিয়েছে সাঁওতাল শ্যামল, মঙ্গল ও সাঁওতাল রমেশ। এখন তাদের সেই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।’

এই মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী এবং জেলা নাগরিক পরিষদ ও আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদের আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০২৪ সালের ২৪ মার্চ মামলাটির পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে। বিষয়টি নিষ্পত্তিতে সরকারের নীরবতা ও দীর্ঘসূত্রিতাই দায়ী।’

তিনি বলেন, ‘আশ্রয়হীন সাঁওতালরা নিরুপায় হয়ে পুনরায় উচ্ছেদ করা জায়গায় গিয়ে বসতি ও চাষাবাদ শুরু করেছে। ইপিজেডের কারণে আবারও তাদের উচ্ছেদ করতে গেলে ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটবে, যা কাম্য নয়।’

রংপুর, যশোর ও পটুয়াখালী ইপিজেটের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল কবির নিউজবাংলাকে জানান, গোবিন্দগঞ্জের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (রংপুর ইপিজেড) বিষয়টি এখনো অনুমোদন হয়নি। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সাঁওতালদের ওই ঘটনা ইপিজেটকে কেন্দ্র করে হয়নি। তা ছাড়া জেলা প্রশাসন এবং চিনিশিল্প কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে যায়গা হস্তান্তর করবে। এরপর আমরা কার্যক্রম শুরু করব। বিষয়টি এখনো অনুমোদনের অপেক্ষায়।’

এ বিভাগের আরো খবর