দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) পরিবেশ দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি না থাকাকে এর জন্য দায়ী করছেন শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে এক বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটির পর আর কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। সর্বশেষ দুই বছর আগে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত নেয়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কমিটি দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় কমিটি।
এক যুগ ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কমিটি না থাকায় কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন নেতা-কর্মীরা।
একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছর ১০ মাসে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে হল দখল, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আট থেকে ১০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে বহু শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১০ সালের ৮ অক্টোবর তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন ও সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন হাবিপ্রবি শাখা ছাত্রলীগের কমিটি অনুমোদন দেন। এতে ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স অনুষদের শিক্ষার্থী ইফতেখারুল ইসলাম রিয়েলকে সভাপতি ও কৃষি অনুষদের শিক্ষার্থী অরুণ কান্তি রায় সিটনকে সাধারণ সম্পাদক করে ছয় সদস্যের একটি কমিটি ঘোষণা করা হয়।
এক বছরের জন্য দেয়া হলে সেই কমিটি অতিক্রম করে প্রায় ১০ বছর। ছাত্রলীগের কমিটি এক বছর অতিক্রম করার পর পরই নেতা-কর্মীরা কয়েক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এরপর থেকে শুরু হয় সংঘর্ষের ঘটনা।
২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়েল ও সাধারণ সম্পাদক সিটনের নেতৃত্বে একটি গ্রপ ও যুগ্ম সম্পাদক জেমি, শেখ রাসেল হলের সভাপতি পলাশ ও ছাত্রলীগ নেতা নয়ন আরেকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েন।
ওই বছর ১৫ এপ্রিল রাতে হল দখল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে মিল্টন ও জাকারিয়া নামে দুই ছাত্রলীগ নেতা নিহত ও শিক্ষক-ছাত্রসহ আহত হয় প্রায় ৩০ জন।
এরপর ২০২১ সালের ২৭ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কমিটির তৎকালীন সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য হাবিপ্রবি শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করে। ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গণশিক্ষা সম্পাদক আব্দুল্লাহ হীল বারী ও উপক্রীড়া সম্পাদক মেহেদী হাসান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ২৮৯ জন পদপ্রত্যাশীর জীবনবৃত্তান্ত জমা নেন।
এরপর প্রায় দুই বছর পার হলেও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় কমিটি।
বর্তমানে ইলিয়াস দেওয়ান, আকাশ, রনির একটি গ্রুপে ও রিয়াদ, সজল, রাহাত, মিঠুর আরেকটি গ্রুপে সক্রিয় রয়েছেন।
তারা জানান, কমিটি না থাকায় ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়েছে অন্তত পাঁচ থেকে ছয়টি গ্রুপে।
চলতি বছরের কিছু সংঘর্ষের ঘটনা
এ বছরের ১৮ জুন সন্ধ্যায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু হল, কাচরুম হল ও নুর হোসেন হলের সঙ্গে এক্সটেনশন হল ও তাজউদ্দীন হলের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। এতে প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থী আহত হন।
৩০ জুন মেয়ে ঘটিত ও পূর্ব শত্রুতার জেরে ডরমেটরি-২ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন আহত হন।
৩০ জুনের সংঘর্ষে রুমের জানালা ও জিনিসপত্র ভাঙচুর করা হয়। ছবি:নিউজবাংলা
১৩ মে রাত ৮টায় হল ইস্যুকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে ১২জন শিক্ষার্থী আহত হন।
একই দিন রাত ১১টায় সিট দখলকে কেন্দ্র করে কাঁচরুম ও টিভিরুমের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ৭ জন আহত হন।
চলতি বছরের ২৭ মার্চ রাত ২টায় হল ইস্যুকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে ৮ জন আহত হন।
১১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে হল ইস্যুকে কেন্দ্র করে টিভি রুম ও কাঁচ রুমের ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন।
৩১ জানুয়ারি মেয়ে ঘটিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে শেখ রাসেল হল ও জিয়াউর রহমান হলের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে ৩ শিক্ষার্থী আহত হয়। এ ছাড়াও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায় ছোট খাটো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানান, এক বছরে দৃশ্যমান ছোটবড় ৮ থেকে ১০টি মারামারি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার পরে উভয়পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করলেও নেয়া হয় না কোনো ব্যবস্থা। পূর্ববর্তী ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রভাব পড়ে পরবর্তী সময়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাবিপ্রবি ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে নেই ছাত্রলীগের কমিটি। এ জন্য কেউ কাউকে মানছেন না। চেইন অব কমান্ড না থাকা, ব্যক্তিস্বার্থের দ্বন্দ্ব, কমিটিতে পদ পাওয়ার জন্য শক্তি প্রদর্শন করতে গিয়েই এ ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
নেতারা জানান, এসব ঘটনায় পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করার ঘটনাও ঘটেছে। মূলত কমিটি না থাকায় নিয়ন্ত্রণহীন ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে।
এ বিষয়ে হাবিপ্রবির কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
গত ২২ সেপ্টেম্বর হাবিপ্রবিতে আসেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। ওই সময় তিনি খুব শীঘ্রই হাবিপ্রবি ছাত্রলীগের কমিটি দেয়ার কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘হাবিপ্রবির শিক্ষার মান, গবেষণার মান উন্নয়ন করতে হবে যেন প্রতিটি শিক্ষার্থী যারা অনেক স্বপ্ন নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে এসেছে তারা মানসম্মত লেখাপড়ার পরিবেশ পায়, ভালো থাকার পরিবেশ পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
‘ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী যারা রয়েছে তাদের সবাইকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এই নির্দেশনা দিচ্ছি যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক পরিবেশ নষ্ট হয় এমন কোনো কার্যক্রম করা যাবে না।’