রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সমাবেশ ঘিরে শনিবার রাজধানী ঢাকায় রাজনৈতিক সহিংসতা সম্পর্কে বিদেশি কূটনীতিকদের অবহিত করেছে সরকার। একইসঙ্গে বিএনপির সংশ্লিষ্টতায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিসেবে পরিচয় দেয়া মিঞা জাহিদুল ইসলাম আরেফীর কর্মকাণ্ডও তুলে ধরা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সোমবার ঢাকায় বিদেশি কূটনৈতিক মিশন, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে ব্রিফ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ব্রিফিংয়ে কূটনীতিকদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনারা ইতোমধ্যে বিএনপি কর্মীদের নিরপরাধ নাগরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও সহিংসতার বিষয়ে জেনেছেন।’
তিনি বলেন, ‘সহানুভূতি পাওয়ার জন্য বিএনপি প্রায়ই কূটনৈতিক মিশন ও আমাদের বিদেশি বন্ধুদের বিভ্রান্ত করতে ভিকটিম হওয়ার ভাণ করে থাকে।
‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং অসাংবিধানিক শক্তিকে উৎসাহিত করতে জাতিকে সন্ত্রস্ত এবং আমাদের জনগণকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে বিরোধীরা সহিংস কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নিয়েছে।’
আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমরা সংবিধান অনুযায়ী বাধ্যতামূলক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অটল থাকার এবং যথাসময়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের সরকারের দৃঢ় ও অটুট অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছি।’
তিনি বলেন, ‘বিরোধীরা সাধারণ মানুষকে বিপথগামী করারও চেষ্টা করছে। এর মধ্যে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একজন কথিত উপদেষ্টাকে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে দলটির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ পরিবেষ্টিত অবস্থায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। পরে দেখা গেছে যে ওই ব্যক্তি একজন প্রতারক।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপির ভীতি ও জালিয়াতির কৌশল আগেও কাজে আসেনি, এখনও আসবে না।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের রাষ্ট্রদূত এবং যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনারসহ প্রায় ৫০ জন কূটনীতিক সংক্ষিপ্ত নোটিশে ডাকা এই ব্রিফিংয়ে অংশ নেন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এ সময় মোমেনের সঙ্গে ছিলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘২৮ অক্টোবর ও এর পরের দিন যা ঘটেছে তাতে সরকার মর্মাহত হলেও অতীতে বিএনপি-জামায়াতের ভয়াবহ সহিংসতার অভিজ্ঞতার কারণে বিস্মিত হয়নি। কিন্তু আমার একমাত্র আফসোস হলো যে তারা খুব একটা বদলায়নি।’
মোমেন কূটনীতিকদের বলেন, ‘বিএনপি ও তার মিত্রদের সহিংসতা ও আগ্রাসনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় বিএনপি ও তার উগ্র ডানপন্থী মিত্র জামায়াতে ইসলামী সহিংসতা ও ভয়-ভীতির পরিবেশ তৈরি করেছিল। ওই নির্বাচন ব্যাপক সহিংসতা ও ভোট কারচুপির অভিযোগে কলুষিত হয়।
‘নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের হত্যা ও মারাত্মক নির্যাতন করেছে এবং নারীদের সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগেও বিএনপি ও তার সহযোগীরা পেট্রোল বোমা ব্যবহার করে কয়েক হাজার গাড়ি ভাংচুর বা অগ্নিসংযোগ করেছে। অনেক সময় ভেতরে আটকে থাকা যাত্রীদের জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে।
‘ওই সময় তাদের পেট্রোল বোমা ও হ্যান্ড গ্রেনেড হামলায় আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর ২০ সদস্যসহ ৪০০ জনেরও বেশি লোক নিহত হয় এবং আহতদের মধ্যে অনেকেই ভয়াবহ ক্ষত ও আঘাত নিয়ে বেঁচে আছেন।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিএনপি কর্মীদের পরিচালিত ব্যাপক সহিংসতার সংক্ষিপ্তসার পাঠিয়েছি।’
মোমেন আশা করেন, ‘বিদেশি কূটনীতিকরা টিভি ও অনলাইন ফুটেজে কীভাবে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বা কীভাবে একটি পাবলিক বাসে আগুন দিয়ে গণপরিবহন শ্রমিকের মূল্যবান জীবন কেড়ে নেয়া হয়েছে তা দেখতে পেয়েছেন।
‘আমি বিশ্বাস করি যে আপনারা ২০১৩-১৪-১৫ এবং এখনকার পরিস্থিতির মধ্যে সম্পূর্ণ মিল লক্ষ্য করেছেন। এবার তাদের লক্ষ্য ছিল পুলিশ ও বিচার বিভাগ।’
তিনি বলেন, ‘একজন পুলিশ সদস্যকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা ছাড়াও বিরোধী দলের কর্মীরা প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারকদের বাসভবনে হামলা চালায়, ছয়টি পুলিশ ফাঁড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। আহত ৬৫ জন পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।
‘এমনকি তারা পুলিশ হাসপাতাল চত্বরে এবং অ্যাম্বুলেন্সে আগুন দিয়েছে, যার ফলে জরুরি চিকিৎসা পরিষেবা ব্যাহত হয়।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি দায়িত্বরত সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানদেরও রেহাই দেয়নি। বাংলাদেশ ফেডারেল ইউনিয়ন অফ জার্নালিস্টস (বিএফইউজে)-এর তথ্য অনুযায়ী, বিএনপি কর্মীরা অন্তত ২৫ জন গণমাধ্যমকর্মীকে আক্রমণ করে গুরুতর আহত করেছে।
মোমেন বলেন, কূটনীতিকরা হয়তো ইতিমধ্যে জানেন যে বিএনপি দল আগামীকাল (মঙ্গলবার) থেকে তিন দিন দেশব্যাপী অবরোধের ডাক দিয়েছে। এ সময় আমরা নিরপরাধ বেসামরিকদের জীবন ও সম্পত্তির ওপর আরও বেশি আক্রমণ হবে বলে আশঙ্কা করছি।’
‘তবে আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে প্রতিটি মানুষের জীবনই গুরুত্বপূর্ণ- আমাদের বিএনপি’র বন্ধুরা সেটা বুঝুন বা না বুঝুন।’
তিনি বলেন, সরকার ‘সর্বোচ্চ ধৈর্য্য ও সংযম প্রদর্শন করবে। তবে ব্যক্তিগত ও সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা এবং দেশকে অস্থিতিশীল করা বা গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করার যেকোনো চেষ্টা নস্যাৎ করতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করা হবে।
‘আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুগুলোও নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা প্রদান এবং জনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে আইনি পরিসীমার মধ্যে তাদের এখতিয়ার অনুযায়ী সবকিছু করবে।’
মন্ত্রী আইনশৃঙ্খলা ইস্যু ছাড়াও ধর্মঘট ও অবরোধের অর্থনৈতিক দিক সম্পর্কে দূতদের অবহিত করেন।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির তথ্যমতে, বিএনপির হরতাল-অবরোধে সারাদেশে মোট ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি হবে।’