রোহিঙ্গা ক্যাম্পের গহীন পাহাড়ে এবার ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির’ (আরসা) টর্চার সেলের সন্ধান পেয়েছে র্যাব-১৫। এ সময় আরসার ওলামা বডির শীর্ষ কমান্ডার টর্চার সেলের প্রধান মো. ওসমান ওরফে সালমান মুরব্বীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে তার তথ্যের ভিত্তিতে আইনের আওতায় আনা হয় টর্চার সেলের অপর সদস্য মো. ইউনুসকে।
তাদের কাছ থেকে ১টি ৯ এমএম বিদেশী পিস্তল, ৪ রাউন্ড গুলি, ৪টি এক নলা ওয়ান শুটার গান, ২টি এলজি, ৫ রাউন্ড ১২ বোর কার্তুজ ও বিপুল পরিমাণ টর্চার সেলের সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে ১টি কুড়াল, ৩টি বিভিন্ন সাইজের প্লায়ার্স, ১টি কাঠের লাঠি, ১টি স্টিলের লাঠি, ১টি করাত, ১টি নাম চাকু, ১টি লোহার রড, ১টি লোহার দা, ১টি হ্যাংগিং হুক, ১টি সিসর, ৪টি তালা, ৩টি বড় লোহার পেরেক, ২টি লোহার শিকল, ১টি রশি, ১টি কুপি বাতি ও সুইসহ সুতার ১টি ্রিহস্পতিবা
বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরনার্থী ক্যাম্পের ৪ নম্বর এক্সটেনশন এলাকায় এই অভিযান চালায় র্যাব-১৫-এর একটি আভিযানিক দল।
শুক্রবার সকালে কক্সবাজারে র্যাব-১৫ সদর দপ্তরে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে খুন, অপহরণ ও টর্চার সেলসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত থাকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে। আরসা প্রধান আতাউল্লাহর নির্দেশে আরসা ২০১৯ সালের শেষের দিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতরে ও ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড় ও গহীন জঙ্গলে টর্চার সেল স্থাপন করে। আরসার কমান্ডার আবু আনাছ সর্বপ্রথম টর্চার সেলের প্রধানের দায়িত্ব পালন করে। পরবর্তীতে মৌলভী আকিজ ওলামা বডির প্রধানের দায়িত্ব নেয়। চলতি বছরের শুরুতে সে মায়ানমারে চলে গেলে সালমান মুরব্বী ওলামা বডির প্রধান ও উক্ত টর্চার সেলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে।
‘এই টর্চার সেলের দায়িত্বে থাকা প্রধান ও অন্যান্য সদস্যরা সাধারণ রোহিঙ্গাদের বিচারের নামে শাস্তিসহ নানা রকমের ভয়ংকর নির্যাতন করে থাকে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন ধরণের কঠোর শাস্তি, অত্যাচার ও নির্যাতন চালানো হতো এই টর্চার সেলে। এছাড়াও শরণার্থী শিবিরের বিভিন্ন লোকজন ও স্থানীয় বাঙ্গালীদের অপহরণ করে টর্চার সেলে আটকে রেখে নির্যাতনের মাধ্যমে বড় অংকের মুক্তিপণ আদায় করা হয়। দাবিকৃত মুক্তিপণের টাকা আদায় করতে অপহৃত ব্যক্তির ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালাতো এই সন্ত্রাসী সংগঠন আরসা।’
তিনি জানান, বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে কয়েকটি জোনে বিভক্ত করে গ্রেপ্তারকৃত সালমান মুরব্বীর নেতৃত্বে মাষ্টার কামাল, মাষ্টার ইউনুছ, জাফর আলম, মৌলভী যুবায়ের, মাষ্টার আবুল হাশিম, মাষ্টার সলিম প্রমুখ আরসার কমান্ডাররা এই ভয়ংকর টর্চার সেলের বিভিন্নভাবে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করতো। সালমান মুরব্বী ২০১৭ সালে সপরিবারে অবৈধপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে থাইংখালীর শরণার্থী ক্যাম্প-১৩-এর ব্লক-ডি/৪ এ বসবাস শুরু করে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে সে আরসার ওলামা কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য ও কমান্ডার মৌলভী মোস্তাক আহম্মদ এবং মৌলভী আবু রায়হানের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’তে (আরসা) যোগদান করে।
সংগঠনে যোগদানের পর আরসার শীর্ষ নেতাদের নিকট অস্ত্র চালনাসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পর্যায়ক্রমে সে ১৩ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্লক জিম্মাদার, হেড জিম্মাদার এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আরসার ওলামা বডির প্রধান হিসেবে নেতৃত্ব লাভ করে। তার নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে শরণার্থী শিবিরে আরসার দাওয়াত গ্রুপের অন্যতম সদস্য মৌলভী লাল মোহাম্মদের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জনের একটি গ্রুপ তৈরী করে। যারা শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী তরুণ ও যুবকসহ সাধারণ রোহিঙ্গাদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে অথবা জোরপূর্বক আরসায় যোগদান করতো। তার এই কার্যক্রমের মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা আরসায় যোগদান করেছে। এ জন্য সে প্রতি মাসে আরসা হতে মোটা অংকের টাকাও পেতো এবং তার মাধ্যমেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ওলামা বডির অন্যান্য সদস্যদের জন্য নির্ধারিত টাকা আসতো বলে জানা যায়। সে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ ও আরসার সেকেন্ড ইন কমান্ড ওস্তাদ খালেদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, সালমান মুরব্বী শরণার্থী ক্যাম্প-১৯-এর হেড মাঝি আনোয়ার ও সাবমাঝি ইউনূস হত্যাকান্ড, জসিম হত্যাকান্ডসহ ক্যাম্প-১৩-এর সকল হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলোচিত ৬ জনের হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন হত্যাকান্ড এবং বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল দলের ওপর সশস্ত্র হামলার সঙ্গে সে জড়িত রয়েছে বলে জানা যায়।
এ ছাড়াও ২০২২ সালের নভেম্বরে গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাবের মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় সন্ত্রাসীদের হামলায় গোয়েন্দা সংস্থার একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হন। ওই সন্ত্রাসী হামলায় একজন র্যাব সদস্য গুরুতর আহত হন। এই হত্যাকান্ডের সঙ্গেও সে সরাসরি জড়িত ছিলেন। উক্ত মামলার পলাতক আসামি তিনি। তার বিরুদ্ধে কক্সবাজারের বিভিন্ন থানায় হত্যা, অপহরণ ও অস্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধে ৬টির অধিক মামলা রয়েছে।
অপরদিকে গ্রেপ্তারকৃত ইউনুছ ২০১৭ সালে সপরিবারে অবৈধপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে উখিয়া থানাধীন কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প-৫ এলাকায় বসবাস শুরু করে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে সে আরসার বাংলাদেশের প্রধান কমান্ডার মৌলভী আকিজ, সামরিক শাখার কমান্ডার মাষ্টার ইউনুছ ও ছমি উদ্দীন এবং গ্রেপ্তারকৃত ওলামা বডির প্রধান জিম্মাদার সালমান মুরব্বীর মাধ্যমে আরসায় সদস্য হিসেবে যোগদান করে। সে সংগঠনে যোগদানের পর আরসার শীর্ষ নেতাদের নিকট হতে অস্ত্র চালনোসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। ২০২১ সালে ডিজিএফআই হত্যাকান্ডের সময়ে আরসার শীর্ষস্থানীয় নেতারা যে ক্যাম্পে অবস্থান করতো তিনি ওই ক্যাম্পে খাদ্য সরবরাহে দায়িত্বরত ছিলেন।
তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানান র্যাবের সিনিয়র সহকারী পরিচালক (ল’ এন্ড মিডিয়া) মো. আবু সালাম চৌধুরী।
র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লে. কর্ণেল এইচ এম সাজ্জাদ জানান, চলতি বছরে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে আরসা’র শীর্ষ সন্ত্রাসী ও সামরিক কমান্ডার, গান কমান্ডার, অর্থ সম্পাদক, আরসা প্রধান আতাউল্লাহ এর একান্ত সহকারী এবং অর্থ সমন্বয়ক, মোস্ট ওয়ান্টেড কিলার গ্রুপের প্রধান ও ক্যাম্প কমান্ডারসহ সর্বমোট ৭৩ জন আরসার সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।