সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) মেয়র হিসেবে এর আগে টানা ৯টি বাজেট ঘোষণা করেছেন আরিফুল হক চৌধুরী। প্রতিবারই উন্নয়ন কাজে সহযোগিতার জন্য সরকার ও স্থানীয় মন্ত্রীদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি। বাজেট ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের প্রশংসা শোনা গেছে মেয়রের মুখে। সরকারের প্রশংসা ও ঘনিষ্ঠতার কারণে বিভিন্ন সময় নিজ দল বিএনপিতে সমালোচনার শিকারও হতে হয়েছে তাকে।
তবে বর্তমান মেয়র হিসেবে নিজের শেষ বাজেট ঘোষণায় এসে সেই আরিফের মুখেই এবার শোনা গেল উল্টো সুর।
বৃহস্পতিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে সিসিকের ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য ৯২৫ কোটি ৪ লাখ ৪৯ হাজার টাকার বাজেট ঘোষণা ঘোষণা করেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এবারের বাজেট বক্তৃতায় তার কণ্ঠে ঝরল সিটি করপোরেশনের উন্নয়নে বৈষম্য ও নিজের ওপর অবিচারের আক্ষেপ।
টানা দুই মেয়াদে সিলেট সিটির মেয়রের দায়িত্ব রয়েছেন আরিফুল হক চৌধুরী। দলীয় নিষেধাজ্ঞার কারণে গত জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত সিলেট সিটি নির্বাচনে অংশ নেননি বিএনপির এই নেতা। আগামী ৮ নভেম্বর দায়িত্ব ছাড়ছেন আরিফুল হক। ফলে মেয়র হিসেবে এটিই তার শেষ বাজেট।
বাজেট বক্তৃতায় আক্ষেপ করে মেয়র আরিফ বলেন, ‘বিগত বছর বন্যার কারণে সিলেটের লাখ লাখ মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও কষ্ট সহ্য করেছে। বন্যার পর সরকারের পক্ষ থেকে শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি, নদী খননসহ নানামুখী আশার বাণী শুনেছিলাম, কিন্তু এখন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।’
অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘সিলেট সিটি করপোরেশনের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৈষম্য হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার ওপরও অবিচার করা হয়েছে।’
বৃহস্পতিবার দক্ষিণ সুরমার একটি কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রদত্ত বাজেটে সমপরিমাণ আয় ও ব্যয় উল্লেখ করা হয়।
বাজেটে উল্লেখযোগ্য আয়ের খাতগুলো হলো- হোল্ডিং ট্যাক্স ৪৮ কোটি ৩৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, স্থাবর সম্পত্তি হস্থান্তরের ওপর কর ২৫ কোটি টাকা, ইমারত নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণের ওপর কর দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা, ট্রেড লাইসেন্স ১০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, বিজ্ঞাপনের ওপর কর ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, বিভিন্ন মার্কেটের দোকান গ্রহীতার নাম পরিবর্তনের ফি ও নবায়ন ফি বাবদ আয় ৮০ লাখ টাকা, ঠিকাদারি তালিকাভুক্তি ও নবায়ন ফি বাবদ আয় ৩০ লাখ টাকা, ল্যাব টেস্ট ফি বাবদ আয় ৬০ লাখ টাকা, বাস টার্মিনাল ইজারা বাবদ আয় ২ কোটি টাকা, ট্রাক টার্মিনাল ইজারা বাবদ আয় ৫০ লাখ টাকা, খেয়াঘাট ইজারা বাবদ আয় ২০ লাখ টাকা, সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি ও দোকান ভাড়া থেকে ৫ কোটি টাকা, রোড রোলার ভাড়া দিয়ে ৫০ লাখ টাকা, রাস্তা কাটার ক্ষতিপূরণ বাবদ আয় ৩০ লাখ টাকা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খাতে আয় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, দক্ষিণ সুরমায় জননেত্রী শেখ হাসিনা শিশু পার্কের টিকিট বিক্রয় থেকে আয় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকাসহ রাজস্ব হিসাব উপাংশ ১-এ মোট ১০৫ কোটি ১২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা এবং পানির সংযোগ লাইনের মাসিক চার্জ বাবদ আয় ৭ কোটি টাকা, পানির লাইনের সংযোগ ও পুনঃসংযোগ ফি বাবদ আয় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা, নলকূপ স্থাপনের অনুমোদন ও নবায়ন ফি বাবদ আয় ২ কোটি ৫০ লাখ টাকাসহ রাজস্ব হিসাব উপাংশ ২-এ মোট ১৮ কোটি ২৭ লাখ ১৬ হাজার টাকা।
সম্মানিত নগরবাসী নিয়মিত হোল্ডিং ট্যাক্সসহ অন্যান্য বকেয়া পাওনা পরিশোধ করলে বাজেট বছরে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব খাতে সর্বমোট ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ১১ হাজার টাকা আয় হবে বলে বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া বাজেটে সিলেট সিটি করপোরেশন, নন-ডিপিপি এবং ডিপিপি সরকারি অর্থায়নে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন খাতে প্রাপ্তি ৫২৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা এবং নিজস্ব মার্কেট নির্মাণ খাতে ৩৭ কোটি টাকা আয় ধরা হয়েছে।
এবারের বাজেটে রাজস্ব খাতে সর্বমোট ১১২ কোটি ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ সংস্থাপন খাতে ৫২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, শিক্ষা খাতে ৪ কোটি ১০ লাখ টাকা, স্বাস্থ্য খাতে ১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, পরিচ্ছন্নতা খাতে ১৯ কোটি ৬০ টাকা, বিদ্যুৎ প্রকৌশল বা সড়ক বাতি খাতে ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা, সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন খাতে ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং বিবিধ খাতে ৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
বিবিধ ব্যয়ের খাতের মধ্যে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ খাতে ৫০ লাখ টাকা, বৃক্ষরোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ৪৫ লাখ টাকা, মোকদ্দমা ফি ও পরিচালনা ব্যয় বাবদ ৫০ লাখ টাকা, জাতীয় দিবস উদযাপন খাতে ৯০ লাখ টাকা, নাগরিক সংবর্ধনা ও আপ্যায়ন ব্যয় বাবদ ৮০ লাখ টাকা, খেলাধুলা ও সংস্কৃতি খাতে ১৫ লাখ টাকা, মেয়র কাপ ক্রিকেট, ফুটবল ও ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট আয়োজনে বরাদ্দ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, জরুরি ত্রাণ খাতে বরাদ্দ ২ কোটি টাকা, আকস্মিক দূর্যোগ/বিপর্যয়/করোনা খাতে বরাদ্দ ২ কোটি টাকা, কার্যালয় বা ভবন ভাড়ায় বরাদ্দ ১ কোটি টাকা, নিরাপত্তা বা সিকিউরিটি পুলিশিং খাতে ৯০ লাখ টাকা, ডিজিটাল মেলা আয়োজনে ২০ লাখ টাকা উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া পানি সরবরাহ শাখার সংস্থাপন ব্যয়সহ পানির লাইনের সংযোগ ব্যয়, পাম্প হাউজ, মেশিন, পাইপলাইন মেরামত, সংস্কার ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধসহ মোট ১৮ কোটি এক লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাজেটে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নে রাজস্ব খাতে ব্যয় বাবদ মোট ৩৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এর মধ্যে রাস্তা নির্মাণ, রাস্তা মেরামত ও সংস্কার, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ, ব্রিজ ও কালভার্ট মেরামত ও সংস্কার, ড্রেন নির্মাণ ও মেরামত, সরঞ্জাম-যন্ত্রপাতি ও সম্পদ ক্রয়, সিটি করপোরেশনের ভবন নির্মাণ ও মেরামত, সিটি করপোরেশনের নিজস্ব স্টাফ কোয়াটার নির্মাণ ও সংস্কার, ঢাকায় সিটি করপোরেশনের নিজস্ব লিয়াঁজো অফিসের জন্য ফ্ল্যাট ক্রয়, কসাইখানা নির্মাণ, ময়লা আবর্জনা ফেলার জায়গার উন্নয়ন, সিটি করপোরেশনের যানবাহন রক্ষায় গ্যারেজ নির্মাণ, সিটি করপোরেশনের যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণে ওয়ার্কশপ নির্মাণ, হাট-বাজার উন্নয়ন, বাস টার্মিনাল সংস্কার ও উন্নয়ন, সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় পাঠাগার নির্মাণ, নাগরিক নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন, গভীর নলকূপ স্থাপন, এমজিএসপি প্রকল্পের রক্ষনাবেক্ষণ কাজের নিজস্ব অর্থ ব্যয়, সিটি করপোরেশনের জন্য জিপ গাড়ি ও দুটি আধুনিক অ্যাম্বুলেন্স ক্রয়, নারীদের উন্নয়নে প্রকল্প গ্রহণ ব্যয় ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।