২০২১ সালের ৭ জুন। সকাল সাড়ে ৯টা। আশুলিয়া থানায় এসআই মো. শফিউল্লাহ শিকদার খবর পান আশুলিয়ার এনায়েতপুর গ্রামের আক্তার হোসেনের বাড়ীর দক্ষিণ পার্শ্বে মো. হাবিবুর রহমানের ফাঁকা জমিতে বস্তাবন্দি অজ্ঞাত একটি মরদেহ পড়ে আছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বস্তায় ভর্তি অজ্ঞাতনামা এক ৩৫ বছর বয়সী পুরুষের অর্ধগলিত লাশ পেয়ে সুরতহাল প্রস্তুত করেন তিনি।
ওই সময় ধারণা করা হয়, অজ্ঞাতনামা আসামি বা আসামিরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে লাশ গুম করার লক্ষ্যে ঘটনাস্থলে বস্তা ভর্তি করে ফেলে রেখেছিল মরদেহ।
এই ঘটনায় আশুলিয়া থানার এসআই মো. শফিউল্লাহ শিকদার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানার একটি হত্যা মামলা করেন। তবে দুই মাস তদন্ত করেও কোনো সমাধানে পৌছাতে না পারলে এবং মামলাটি ক্লুলেস হওয়ায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে মামলাটির তদন্তভার পিবিআই ঢাকা জেলায় হস্তান্তর হয়। এসআই মো. আনোয়ার হোসেন মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন পিআইবির পক্ষ থেকে।
তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. আনোয়ার হোসেন মামলার ঘটনাস্থলসহ আশপাশে যোগাযোগ করেন। পার্শ্ববর্তী ৫ম তলা বিডিংয়ের মালিক আক্তার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, অজ্ঞাত মরদেহ পাওয়ার পরের দিন তার বাসার নিচতলার ভাড়াটিয়া চম্পা নামের তৃতীয় লিঙ্গের এক ব্যক্তি তার বাবার অসুস্থ্যতার কথা বলে গ্রামের বাড়ী জামতলী নারায়ণপুর, জামালপুর সদরে গেছে।
তদন্ত কর্মকর্তা যোগাযোগ করে জানতে পারেন, উক্ত ঠিকানায় চম্পা হিজড়া নামের একজনের বাড়ী আছে যার পূর্বের নাম ছিল নওশাদ। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, আনুমানিক ২০ বছর পূর্বে নওশাদের পিতা-মাতা মারা গেছেন এবং সে ঢাকায় বসবাস করলেও মাঝে মধ্যে গ্রামে যান তিনি।
পিতা-মাতা না থাকা স্বত্ত্বেও মরদেহ উদ্ধারের পরের দিন পিতার অসুস্থতার কথা বলে নওশাদ ওরফে চম্পা হিজড়া বাসা ত্যাগ করে গ্রামে চলে যাওয়া তদন্ত কর্মকর্তার সন্দেহ হয়। তাকে খোঁজাখুজির এক পর্যায়ে একটি ঠিকানা পাওয়া যায়। তদন্ত কর্মকর্তা রাকিব হাসান শাওনের স্থায়ী ঠিকানায় যোগাযোগ করে তার পিতার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ এবং যোগাযোগ করেন আনোয়ার হোসেন। শাওনের বাবা জানান, তার ছেলে শাওন ঢাকার আশুলিয়ায় এক হিজড়ার সঙ্গে বসবাস করেন। রাকিব হাসান শাওনের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত একটি মোবাইল নম্বরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান এই নম্বরটি তার ছেলের। কিন্তু মরদেহের ছবি দেখালেও তিনি তার ছেলের মরদেহ সনাক্ত করতে পারেননি।
পরবর্তীতে তদন্ত কর্মকর্তার অনুরোধে তিনি ডিএনএ পরীক্ষা করান এবং নিশ্চিত হওয়া যায়, ঢাকার আশুলিয়ায় পাওয়া মরদেহটি শাওনের।
তদন্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে পিবিআই ঢাকা জেলা তদন্ত টিম ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে চম্পা হিজড়াকে গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে তার গ্রামের ঠিকানায় অভিযান পরিচালনা করেন।
এক পর্যায়ে জানা যায়, চম্পা হিজড়া তার নাম পরিবর্তন করে স্বপ্না হিজড়া নামে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানা এলকার হিজড়া পল্লিতে আত্নগোপণ করে আছেন। উক্ত হিজড়া পল্লিতে অভিযান পরিচালনা করে চলতি বছরের ১৭ অক্টোবর রাত আটটার দিকে তাকে গ্রেপ্তার করে তদন্তকারী দলটি।
গ্রেপ্তারের পর পুলিশ ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন পূর্বক তাকে আদালতে সোর্পদ করলে আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।
হিজড়া হওয়ার আগে নওশাদ (বাঁয়ে) এবং হিজড়া হবার পরে চম্পা ওরফে স্বপ্না (ডানে)। কোলাজ: নিউজবাংলা
আসামি চম্পা ওরফে স্বপ্নাকে করা জিজ্ঞাসাবাদে বেড়িয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
চম্পা ওরফে স্বপ্না জনায়, সে জন্মগতভাবে হিজড়া ছিল না। সে বিবাহিত, পুরুষ এবং তার পূর্বের নাম ছিল নওশাদ। তার ১২ বছর বয়সী পুত্র সন্তান আছে। প্রায় ১১ বছর আগে তার স্ত্রী মারা গেলে সে কর্মবিমুখ হয়ে বেকার জীবনযাপন করতে থাকে এবং হতাশ হয়ে পড়ে। স্ত্রী মারা যাওয়ার কিছু দিন পর তার সঙ্গে দেলু হিজড়ার পরিচয় হয়। দেলু হিজড়া নওশাদকে হিজড়া হওয়ার প্রস্তাব দেয় এবং বলে হিজড়া হলে সে অনেক টাকা আয় করতে পারবে। দেলু হিজড়ার কথায় প্রলুব্ধ হয়ে নওশাদ হিজড়াদের দলে যোগ দেয়। এর দেড় বছর পর দেলু হিজড়ার কথামত খুলনার লোহাপাড়ায় একজন ডাক্তারের মাধ্যমে অপারেশন করে মেয়ে হিজড়া হয় সে। হিজড়া হওয়ার পরে নওশাদ তার নাম পরিবর্তন করে চম্পা নাম ধারণ করে দেলু হিজড়ার অধীনে ৪ থেকে ৫ বছর কাজ করে।
পরবর্তীতে সে ঢাকার আশুলিয়ার এনায়েতপুরে গিয়ে বসবাস শুরু করে। এনায়েতপুরে বসাবাসকালে শাওনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। শাওন অবিবাহিত ছিলেন। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তারা একসঙ্গে ভাড়া বাসায় বসবাস করতে শুরু করে। ভিকটিমের সম্পূর্ণ খরচ তিনিই বহন করতেন বলেও জানান আসামি।
২০২১ সালে পয়লা জুন ভিকটিম রাকিব তার নিকট এক হাজার টাকা চায়। টাকা না দেয়ায় শাওন তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে বলে জানান চম্পা। কিছুক্ষণ পর শাওন তার কাছে ২০ টাকা চায়। সে ভিকটিমকে ২০ টাকা দিলে ঐ টাকা দিয়ে রাকিব দুইটা মাইলাম ট্যাবলেট কিনে খায়। মাইলাম ট্যাবলেট কিনতে যাওয়ার সময় রাকিব তার মোবাইল ফোনটি বাসায় রেখে গেলে ঐ সময় শাওনের মোবাইল ফোনে রিপা নামের আরেকজন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি ফোন করে।
চম্পা ওরফে স্বপ্না ফোন কলটি রিসিভ করে জানতে পারেন, রিপার সঙ্গেও শাওনের প্রেমের সম্পর্কসহ শারিরীক সম্পর্ক রয়েছে। শাওন বাসায় ফিরে এলে চম্পা ভিকটিমের কাছে রিপার বিষয়ে জানতে চান। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হলে চম্পা শাওনের গলায় গামছা পেচিঁয়ে তাকে হত্যা করেন। হত্যার পর আসামি চটের বস্তায় ভিকটিমের মরদেহ ভরে পাশের রুমে রেখে গুম করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। ৫ দিন পর ৬ষ্ঠ দিনের মাথায় ২০২১ সালের ৭ জুন প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে সন্ধার পরে এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় সে বস্তায় ভরে রাখা ভিকটিমের মরদেহটি নিয়ে রাতের অন্ধকারে বাসার পাশে ঝোপের মধ্যে (ঘটনাস্থলে) ফেলে রেখে সে তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে থাকে।
পরের দিন সকালে স্থানীয় লোকজন বস্তাবন্দি মরদেহ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দিলে চম্পা পালিয়ে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানা এলকার হিজড়া পল্লিতে গিয়ে তার চম্পা নাম পরিবর্তন করে স্বপ্না হিজড়া নামে আত্নগোপণ করে।
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে চম্পা ওরফে স্বপ্না হিজড়াকে আদালতে সোপর্দ করা হলে সে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।