বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ময়মনসিংহে বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবায় অনিয়মের অভিযোগ

ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নগরীর স্বাস্থ্য খাতের বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। কোথাও নিয়মের ব্যত্বয় ঘটলে অভিযান চালিয়ে ওই সব প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি অনেকগুলো অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করেছি।’

ময়মনসিংহ শহরের বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতে গড়ে ওঠা অনেক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্যসেবার নামে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

কিছু রোগী ও স্বজনরা দৃষ্টিনন্দন সাইনবোর্ড দেখে সেবা নিতে গেলেও, অনেকে যান দালালের হাত ধরে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের রয়েছে আলাদা আলাদা দালাল চক্র। এরা ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ (মমেক) হাসপাতালের ভেতর ও বাইরের এলাকাসহ শহরের বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে নিয়োজিত থাকেন। দালালের মাধ্যমে চলে রোগী আনার প্রতিযোগিতা। এরপর অপারেশনের রোগীগুলোকে কম খরচের কথা বলে চিকিৎসক এনে ওটি করানো হয়।

আরও জানা যায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী চিকিৎসক বা নার্স নেই। রোগী নিয়ে গেলে চিকিৎসক, নার্স ডাকা হয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চলে চিকিৎসা, হচ্ছে অপারেশনও। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের অপারেশন থিয়েটারগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। অপারেশন করার কোনো পরিবেশ সেখানে থাকে না। অনেক হাসপাতালে থাকে মরিচা পড়া যন্ত্রপাতি।

সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, একটি ১০ শয্যার ক্লিনিকে তিনজন ডিউটি চিকিৎসক ও ছয়জন নার্স সার্বক্ষণিক থাকতে হয়। এর চেয়ে বেশি বেডের প্রতিষ্ঠান হলে দ্বিগুণ ডিউটি চিকিৎসক ও নার্স থাকতে হবে, কিন্তু এখানে অনেক প্রতিষ্ঠানে একজন ডিউটি চিকিৎসকও রাখা হয় না। তবুও প্রতিষ্ঠানের মালিকরা চিকিৎসক এনে ওটি করান। অপারেশনের পর ওটির চিকিৎসকরা চলে যান।

শহরের বেসরকারি হাসপাতালে সেবা গ্রহীতাদের অভিযোগ

সিটি কর্পোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের চর কালিবাড়ী এলাকার সাজ্জাদ হোসেন রাসেল বলেন, ‘গত মাসে আমার গর্ভবতী শ্যালিকা সাজেদা আক্তারকে পূর্বপরিচিত ইমরান নামের হাসপাতালের ম্যানেজারের পরামর্শে শহরের বসুন্ধরা হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিকে নিয়ে গিয়েছিলাম।

‘রাত দশটার দিকে হাসপাতালটিতে সিজারের পর চিকিৎসক চলে গেলে সাজেদার অবস্থা খারাপের দিকে চলে যায়। ধীরে ধীরে পেট ফুলতে থাকে। ওই সময় হাসপাতালে ছিল না কোনো ডিউটি চিকিৎসক। এমতাবস্থায় তড়িঘড়ি করে ইমরান নিজেই রোগীকে ৪ থেকে ৫টা ইঞ্জেকশন পুশ করে। এতে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়।

তিনি বলেন, ‘চোখের সামনে রোগী মারা যাচ্ছে দেখে ইমরানের পরামর্শে মমেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে আমার শ্যালিকা মারা যায়। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি নেয়া হলেও ময়নাতদন্তে মরদেহ কাটাছেঁড়াসহ পরিবারের অসম্মতি থাকায় পরে মামলা করা হয়নি।’

একই এলাকার নজরুল ইসলাম নামের আরেকজন বলেন, ‘কয়েক মাস আগে আমার স্ত্রীকে দ্বিতীয়বার সিজারের জন্য পরিচিত লোকের মাধ্যমে শহরের এপেক্স হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলাম। সিজারের পর স্ত্রীসহ আমার নবজাতক সন্তান সুস্থ ছিল, কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই স্ত্রীর পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়।

‘হাসপাতালে যোগাযোগ করলে তারা জানায় হাসপাতাল থেকে সঠিকভাবেই সিজার করা হয়েছে। অন্য কোনো কারণে ব্যথা করছে। পরে মমেক হাসপাতালে একজন চিকিৎসকের পরামর্শে আল্ট্রাসনো করা হয়। তখন রিপোর্টে ধরা পরে পেটের ভেতর গজ রেখেই সেলাই করা হয়েছে।

‘পরে ওই হাসপাতালের মালিককে জানালেও ভুল চিকিৎসা হয়েছে স্বীকার করেনি।’

ত্রিশাল উপজেলার আউটিয়াল গ্রামের রিকশাচালক আনিসুর রহমানের স্ত্রী হাসিনার প্রসব ব্যথা উঠলে গত ১৭ জুন তাড়াহুড়ো করে নগরীর চরপাড়া ব্রাহ্মপল্লী ১৩/বি হেলথ কেয়ার প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ভর্তির পর রাত সাড়ে ৯টার দিকে গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. রুপা আক্তার সিজার করেন।

হাসিনার স্বামী আনিসুর রহমান জানান, সিজারের পর মা-সন্তান দুজনই সুস্থ ছিল। ২০ জুন ক্লিনিক থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়, তবে ক্ষত সারছিল না। পরে স্থানীয় চিকিৎসক দিয়ে ড্রেসিং করানো হয়। ড্রেসিং করার সময় ক্ষত জায়গায় একটি সুতা পাওয়া যায়।

গত ১৪ আগস্ট মমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় হাসিনাকে। সেখানে আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে ধরা পড়ে জরায়ুতে গজের মতো কিছু একটা রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘ভেতরে মপ (রক্ত পরিষ্কারের জন্য তুলা ও কাপড় দিয়ে তৈরি বস্তু) রেখেই সেলাই করে দিয়েছিল চিকিৎসক। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য সব মিলিয়ে দুই লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে। খুব কষ্ট করে এই টাকা জোগাড় করেছিলাম। চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করলে কিছুই হয় না জানতে পেরে মামলা করিনি।’

এ ছাড়াও এ বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ভুল চিকিৎসায় নারী রেখা আক্তারসহ তার দুই জমজ সন্তান মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়। ওই ঘটনায় রেখা আক্তারের স্বামী মাহবুব আলম বাদী হয়ে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিক মিয়া, অমিত, ডা. মো. আশরাফুল হক মোল্লা, ডা. আরিফ রব্বানী, মেহেদী ও মো. তারেক মিয়ার বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেন।

স্বজনদের অভিযোগ, সার্জারি করার সময় রেখা আক্তারের মারাত্মক রক্তক্ষরণ শুরু হয় ও একপর্যায়ে মৃত্যু হয়। এ অবস্থায় জোর করেই রেখার নিথরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয়া হয় অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওই ঘটনায় জেলা সিভিল সার্জন ডা. নজরুল ইসলাম পেশেন্ট হাসপাতালটিকে অবৈধ হাসপাতাল উল্লেখ করে সিলগালা করেন।

কথা হয় সালমা নামে একজন সিজারিয়ান রোগীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি নরমাল ডেলিভারিতে বাচ্চা প্রসব হবে না চিকিৎসক জানালে পরিচিত একজনের মাধ্যমে চলে যাই শহরের ব্রাক্ষপল্লী এলাকায় আল আকসা হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে দেখি ভেতরের পরিবেশ দুর্গন্ধময়। দোতলার বাথরুম থেকে চারিদিকে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। নার্স ও ডিউটি চিকিৎসক দেখা যায়নি। তখন এখানে সিজার করা ঠিক হবে না বুঝতে পেরে দ্রুত আরেকটি হাসপাতালে চলে যাই।’

শাহরিয়ার মেহেদী নামের একজন স্থানীয় বলেন, ‘ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আশপাশের বিভিন্ন এলাকার যে দিকে চোখ যায় শুধু বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাইনবোর্ড। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার নামে ওখানে শুধু বাণিজ্য চলছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।’

হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি হাসপাতালের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে লাইসেন্স না পাওয়া পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান চালানোর নিয়ম নেই। তবুও দিন-দুপুরে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান চলছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তর ইচ্ছে করলে নিমিষেই অবৈধ সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে পারে, কিন্তু তা করেনা।’

তিনি বলেন, ‘দালাল ছাড়া রোগী নিয়ে আসা খুবই কঠিন। তাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক দালাল নিয়োগ দেয়া হয়। তারা বিভিন্ন কায়দায় রোগী নিয়ে আসেন।’

হাসিনার সিজার হওয়া হেলথ কেয়ার প্রাইভেট হাসপাতালের ম্যানেজার রুহুল আমিন বলেন, ‘আমরা ভর্তি করে বাইরের চিকিৎসক দিয়ে সিজার করে দিয়েছি। এখন চিকিৎসক জরায়ুর ভেতরে কী রেখে অপারেশন করেছে সেটা তো আমাদের দেখার বিষয় না। এ বিষয়ে ওই চিকিৎসক ভালো বলতে পারবেন।’

পরে চিকিৎসক রুপা আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক অনার্স অ্যাসোসিয়েশন ময়মনসিংহের সাধারণ সম্পাদক ও বসুন্ধরা হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এইচ এ গোলন্দাজ বলেন, ‘আমরা চাই, রোগীদের সব প্রতিষ্ঠানে ভালো চিকিৎসাসেবা দেয়া হোক। অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অভিযানকে স্বাগত জানাই। দালালদের মাধ্যমে অনেকের প্রতিষ্ঠানে রোগী আনা হলেও আমার প্রতিষ্ঠানে কখনোই দালালদের মাধ্যমে রোগী এনে ভর্তি করা হয় না। এ জন্য সবচেয়ে পুরাতন প্রতিষ্ঠান হয়েও রোগীর সংখ্যা কম। রোগী কম হলেও সঠিক সেবা দেয়া হচ্ছে।

আপনার প্রতিষ্ঠানে ভুল চিকিৎসায় সাজেদা খাতুন নামের এক নারী মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে কেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কোনো চিকিৎসক চায় না রোগী মারা যাক। তবুও অনেক সময় মারা গেলে চিকিৎসকসহ ওই প্রতিষ্ঠানের মালিককে দোষারোপ করা হয়। সঠিকভাবে সিজার করার পরও ওই নারী মারা গিয়েছে। এখানে কারো গাফিলতি নেই।’

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নগরীর স্বাস্থ্য খাতের বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। কোথাও নিয়মের ব্যত্বয় ঘটলে অভিযান চালিয়ে ওই সব প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি অনেকগুলো অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করেছি।’

তিনি বলেন, ‘কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কারও অভিযোগ থাকলে আমাদের জানানো প্রয়োজন। তাহলে যাচাই বাছাই করে প্রমাণ মিললে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায়। তবে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হওয়াসহ নানা সমস্যা অনেক সময় আড়ালে থেকে যাওয়ায় ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না।’

এ বিভাগের আরো খবর