দেশের মানচিত্রে সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। এই জেলার সীমান্ত ঘেঁষে প্রবাহিত হয়েছে প্রায় ২৫টি নদ-নদী। এগুলোর মধ্যে করতোয়া ও মহানন্দা বড় নদী। মহানন্দা বাংলাদেশ ও ভারতের ভূখণ্ডকে বিভক্ত করেছে তেঁতুলিয়ায়।
স্বাধীনতার তীর্থভূমি ৭১-এর মুক্তাঞ্চল তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোর পাশ ঘেঁষে প্রবাহিত মহানন্দা নদীর পানিতে ভেসে আসা নীল নুড়িপাথর এ অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকার জোগান দিয়ে আসছে বহু বছর ধরে।
নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকায় এসব মানুষের জীবন সংগ্রাম এবং শ্রম এই জেলার গ্রামীণ অর্থ-বাণিজ্যে বিশেষ ভূমিকা রাখলেও বর্তমানে টান পড়েছে সেই আয়-রোজগারে।
মহানন্দা বাংলাদেশে গঙ্গার একমাত্র উপনদী। নেপালের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হিমালয় থেকে উদ্ভব হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কার্সিয়ান ও শিলিগুড়ি অতিক্রম করে ভারতের ফুলবাড়ি দিয়ে বাংলাবান্ধার ঝাড়ুয়াপাড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের শূন্য রেখায় প্রবাহিত হয়েছে নদীটি।
বাংলাবান্ধার ঝাড়ুয়াপাড়া সীমান্ত থেকে তেঁতুলিয়া সদরের পুরাতন বাজার পর্যন্ত আঁকাবাঁকা পথে প্রায় ২০ কিলোমিটার প্রবাহিত নদীটি ভারত-বাংলাদেশ সীমারেখা চিহ্নিত করে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করেছে।
১৮৭৬ সালের উইলিয়ম হান্টারের জরিপ থেকে জানা যায়, মহানন্দা একসময় প্রশস্ত এবং গভীর নদী ছিল, যার বুকে চলাচল করত বড় বড় মালবাহী নৌকা। মহানন্দা নদীর পূর্বভাগে বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলা আর পশ্চিমভাগে ভারতের দার্জিলিং জেলার শিলিগুঁড়ি ও চটেরহাট থানা।
মহানন্দা নদীর জলরাশিতে ভোর বেলা যখন সূর্যের লাল রশ্মি ঝলঝল করে সোনালী আলোর ঝিলিক পড়ে, তখন জেলেদের মতো মোটরগাড়ির টিউব, নেট, কোদাল আর বালু কাটার যন্ত্র নিয়ে হাজারো শ্রমিক ছুটে চলে মহানন্দায় নুড়িপাথর সংগ্রহের কাজে।
আশির দশকের আগে থেকে মহানন্দা নদীতে শ্রমিকদের নুড়িপাথর সংগ্রহ শুরু হলেও পাথরের কোনো কমতি ছিল না এই এলাকায়। বর্তমানে নদীতে চর পড়ে যাওয়ায় এবং পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মুখে।
মহানন্দা একটি আন্তঃসীমান্ত নদী হওয়া সত্ত্বেও নব্বই দশকের পর ফুলবাড়ি নামক স্থানে ভারত একতরফা বাঁধ নির্মাণ করে মহানন্দা নদীর পানির গতিপথ পরিবর্তন করে ফেলে। ফলে মহানন্দা নদীর খরস্রোতে ভাটা পড়ে। নদীর বুকে জেগে ওঠে ধূ ধূ বালুচর।
সীমান্ত রেখায় এই নদীর অবস্থান হওয়ায় শুরু থেকেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পাথর তোলায় বাধা দেয়। সেই বাধা উপেক্ষা করে নদীতে পাথর তুলতে গিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত গ্রাম ঝাড়ুয়াপড়া, সন্ন্যাসীপাড়া ও দক্ষিণ-উত্তর কাশিমগঞ্জ গ্রামের বেশ কয়েকজন পাথরশ্রমিক বিএসএফের গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান।
সীমান্তের এই সংঘাতে মাঝেমধ্যে মহানন্দা নদীতে পাথর তোলা বন্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী পতাকা বৈঠক করে বিরোধ নিষ্পত্তি করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করলেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। পরবর্তীতে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করে ভারত। বর্তমানে সংঘাত এবং প্রাণহানি কিছুটা কমে এসেছে।
বর্তমানে মহানন্দা নদীতে বর্ষা মৌসুমে মোটরগাড়ির টিউব পানিতে ভাসিয়ে এবং শুস্ক মৌসুমে শ্রমিকেরা দুটি ঢাঁকির ভার সাঁজিয়ে ঘাড়ে করে বালুর চর বেয়ে পাথর সংগ্রহ করে।
সর্দারপাড়া গ্রামের পাথর শ্রমিক জাহাংগীর, বারঘরিয়া গ্রামের আশরাফুল ও সাহেবজোত গ্রামের হবিবর রহমান জানান, মহানন্দা নদীর পাথর তুলে তাদের পূর্বপুরুষেরা জীবন নির্বাহ করেছেন। তারাও এই নদীতে পাথর তুলে পরিবার নিয়ে জীবিকা চালিয়ে আসছেন। তাদের ছেলে-মেয়েরাও পড়াশোনার ফাঁকে নদীতে পাথর তোলার কাজ করে থাকে।
বর্তমানে তেঁতুলিয়া উপজেলার বাসিন্দা ছাড়াও পঞ্চগড় জেলার বিভিন্ন থানা এবং ঠাকুরগাঁও ও নীলফমারী এলাকার খেটে খাওয়া মানুষজন এই এলাকায় নদীতে পাথর তোলার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
শ্রমিকরা জানান, ভারতের বিএসএফ এখন পাথর তুলতে বাধা দিচ্ছে। এছাড়াও নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় উজান থেকে আগের মতো পাথরও আসছে না। ফলে সারাদিন পরিশ্রম করেও চাহিদামতো পাথর সংগ্রহ করতে পারছেন না তারা। এলাকায় বিকল্প কোনো কাজ না থাকায় জীবন-জীবিকা আটকে গেছে তাদের।
পাহাড় থেকে নেমে আসা বিভিন্ন নদ-নদীর হিম শীতল বরফগলা পানিতে নেমে পাথর সংগ্রহকারী এই মানুষগুলো বর্তমানে চর্ম রোগ, এলার্জি, বাত-ব্যথাসহ নানা রোগে ভুগছেন। একজন শ্রমিক দিনে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা পাথর সংগ্রহ করে ৮০০ থেকে হাজার টাকা আয় করে। প্রতি ঘনফুট (এক সেফটি) পাথর বর্তমানে ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়। ব্যবসায়ীরা সেই পাথর চড়া দামে বিক্রি করছে দেশের বিভিন্ন চালান ক্ষেত্রে।