১৩৬ বছরের পুরোনো ২৯ দশমিক ৪৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের টাঙ্গাইল পৌরসভার ১৮টি ওয়ার্ডে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে খেলার মাঠ।
শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসচেতন পৌর বাসিন্দাদের খেলাধুলা ও শরীর চর্চা করার মাঠগুলোতে গড়ে উঠেছে বড় বড় আকাশচুম্বী অট্টালিকা। কোনো কোনো মাঠে বসানো হয়েছে কাঁচাবাজার। আবার অনেক মাঠের জায়গার মালিকেরা প্লট আকারে বিক্রি করে দিয়েছেন তাদের ব্যক্তিগত জায়গা।
পৌরসভা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যেই পৌর এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে হারিয়ে গেছে ১৬টি খেলার মাঠ। আরও কয়েকটি খেলার মাঠ হারাতে বসেছে। কারণ, বিভিন্ন ওয়ার্ডে যে কয়টি খেলার মাঠ এখনও রয়েছে সেগুলোও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধীরে ধীরে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, বছর জুড়ে মাঠগুলো বাণিজ্য মেলাসহ রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকে।
তাদের অভিযোগ, উঠতি বয়সী ছেলে মেয়েরা খেলাধুলার সুযোগ না পাওয়ায় ধীরে ধীরে আসক্ত হচ্ছে মোবাইল ফোনে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর গবেষণায় জানা গেছে, শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রতিদিন ন্যূনতম এক ঘণ্টা করে খেলাধুলা ও শারীরিক সক্রিয় কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকা প্রয়োজন।
টেকসই নগরায়ণ সংক্রান্ত জাতিসংঘের সংস্থা ইউএন-হ্যাবিটেটের তথ্য অনুযায়ী, হাঁটার দূরত্বে খেলার মাঠ থাকা উচিত। অতিঘন নগর এলাকায় প্রতি অর্ধবর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যা বিবেচনায় ন্যূনতম একটি করে খেলার মাঠ থাকা প্রয়োজন।
টাঙ্গাইল পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে মাঠের বর্তমান চিত্র
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টাঙ্গাইল পৌর এলাকার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে খেলার মাঠের জায়গায় বসতভিটা গড়ে উঠেছে। এই ওয়ার্ডের থানাপাড়া এলাকার রেঞ্জার মাঠ, সবুজ সেনা মাঠ, থানাপাড়া ইস্টার্ন ক্লাব মাঠের (বাবুর্চির মাঠ) জায়গায় এরই মধ্যে বসতি গড়ে উঠেছে। ঘনবসতিপূর্ণ এই ওয়ার্ডে ৩টি খেলাধুলার ক্লাব থাকলেও তাদের কোনো খেলার মাঠ নেই।
স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, ২ নম্বর ওয়ার্ডের ঠাকুর বাড়ির মাঠটি মালিকানা দ্বন্দ্বে এলাকার শিশু-কিশোরদের ওই মাঠে খেলাধুলা প্রায় বন্ধ। স্থানীয়দের আন্দোলনের মুখে, বর্তমানে শিশু-কিশোররা ওই মাঠে খেলাধুলার সুযোগ পেলেও ভবিষ্যতে ওই মাঠের জায়গা প্লট আকারে বিক্রির আলোচনা চলছে।
তিনি জানান, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মির্জা মাঠ ও হাউজিং মাঠে নিকট অতীতে ওই এলাকার শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করতো। এ ছাড়া সকাল ও বিকেল স্বাস্থ্য সচেতন লোকজন শরীরচর্চা করতো এই মাঠ দুটিতে। বর্তমানে মাঠগুলোতে বসতি গড়ে উঠেছে।
৬ নম্বর ওয়ার্ডের কলেজ পাড়ার বালুর মাঠে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল ইমারত। একই এলাকার পানির ট্যাংকের মাঠে এখন আর শিশু-কিশোরদের প্রবেশ অধিকার নেই।
একই চিত্র ১১ নম্বর ওয়ার্ডের খালপাড় মাঠে। গড়ে উঠেছে বসতি; খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই।
প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে, টাঙ্গাইল পৌর এলাকার ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের ছোট কালিবাড়ী খেলার মাঠ ও কেওছার মাঠের এখন আর অস্তিত্ব নেই। এ ছাড়া নজরুল সেনা মাঠের জায়গায় গড়ে উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শহিদ স্মৃতি পৌর উদ্যান।
এই ওয়ার্ডের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে এক সময় টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন এলাকার শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি খেলাধুলা ও শরীরচর্চায় ব্যস্ত থাকতো। বর্তমানে এই মাঠের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে বসেছে ট্রাকস্ট্যান্ড। ফলে শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সের লোকজন শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই মাঠটি খেলাধুলা ও শরীরচর্চার জন্য এখন আর ব্যবহার করতে পারছে না।
১৭ নম্বর ওয়ার্ডের শিমুলতলী এলাকার বালুর মাঠে এখন গড়ে উঠেছে বসতি ও বিভিন্ন ধরনের ফল ও গাছের বাগান। ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কোদালিয়া মাঠটি এখন শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অ্যাকাডেমিক ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানান বাসিন্দারা।
শহরের নামকরা একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র জিসান আহমেদের (ছদ্মনাম) সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয় শহিদ স্মৃতি পৌর উদ্যানে।
জিসান বলে, ‘বিকেল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত বন্ধুদের সঙ্গে পৌর উদ্যানে আড্ডা দেই। এক সময় আমার ওয়ার্ডে তিনটি খেলার মাঠ থাকলেও বর্তমানে কোনো খেলার মাঠ নেই। খেলাধুলার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকটা বাধ্য হয়েই পৌর উদ্যানে এসে আড্ডা দেই।’
সরকারি সৈয়দ মহাব্বত আলী কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘পৌর শহরে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকার ফলে শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তারা ধীরে ধীরে আসক্ত হচ্ছে মোবাইল ফোনে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মোবাইল আসক্তি থেকে রক্ষা করার জন্য পৌর এলাকায় শিশু-পার্ক ও খেলার মাঠের কোনো বিকল্প নেই। পৌর শহরে যে কয়টি খেলার মাঠ এখনও অবশিষ্ট আছে সেগুলো রক্ষা করার জোর দাবি জানাচ্ছি।’
এ বিষয় টাঙ্গাইল পৌর মেয়র এস এম সিরাজুল হক আলমগীর বলেন, ‘ব্যক্তি মালিকানাধীন মাঠগুলোর ব্যাপারে পৌর কর্তৃপক্ষের করণীয় কিছু নেই, তবে কেন্দ্রীয় ঈদগাহ, জেলা পরিষদ মাঠ ও শহিদ স্মৃতি পৌর উদ্যানে পৌরসভার উন্নয়নমূলক কাজের জন্য কিছু জিনিসপত্র রাখা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগামী ১ মাসের মধ্যেই মাঠগুলো পরিষ্কার করে আবার খেলাধুলার উপযোগী করা হবে। এ ছাড়া ৩নম্বর ওয়ার্ডের হাউজিং স্টেটে শিশু-কিশোরদের জন্য একটি খেলার মাঠ তৈরি করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মো. ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঈদগাহ মাঠকে যত দ্রুত সম্ভব খেলাধুলার উপযোগী করে গড়ে তোলা হবে। এরই মধ্যে আমি এ বিষয়ে পৌর মেয়রের সঙ্গে আলোচনা করেছি।’
তিনি জানান, শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা ও মানসিক বিকাশের জন্য টাঙ্গাইল পৌর শহরের অদূরে দাইন্যা ইউনিয়নের বাসাখানপুরে নির্মিত হচ্ছে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খেলাধুলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন বলেই দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মিনি স্টেডিয়াম তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।