জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রাপ্তি, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন-পদোন্নতি, সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়া- হেন কোনো কাজ নেই যার চাবিকাঠি তার কাছে। সবই সম্ভব, বিনিময়ে কেবল চাই টাকা।
‘সর্বকাজের কাজী’ এই ব্যক্তির নাম আবু হানিফ তুষার ওরফে হানিফ মিয়া। ভয়ঙ্কর এই প্রতারক নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নিকটাত্মীয় হিসেবে মিথ্যা পরিচয়ে নানামুখী প্রতারণা করে আসছিলেন।
সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাইয়ে দেয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে কিছু কিছু রাজনীতিবিদের কাছে তিনি দুশ’ থেকে পাঁচশ’ কোটি টাকা পর্যন্ত দাবি করেন। পদায়ন-পদোন্নতি ও চাকরির প্রলোভনেও হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অর্থ।
প্রতারণার টাকায় তিনি বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছেন। পরিবহন সেক্টরে রয়েছে তার বেশ কয়েকটি দূরপাল্লার গাড়ি। চড়েন নিজস্ব গাড়িতে।
প্রতারক চক্রের এই হোতাকে বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রসহ রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
আবু হানিফ তুষারকে গ্রেপ্তারের সময় উদ্ধার করা আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি। ছবি: নিউজবাংলা
সূত্র জানায়, সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম-পরিচয় ভাঙিয়ে ঠিকাদারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎকারী প্রতারক চক্রের হোতাসহ দু’জনকে রাজধানীর পল্টন থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১ এ অভিযান চালিয়ে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আবু হানিফ তুষারকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তার তুষার প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের নিকটাত্মীয় হিসেবে মিথ্যা পরিচয় ও সুসম্পর্কের কথা বলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রাপ্তি, গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন ও পদোন্নতি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়াসহ বিভিন্ন মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অংকের অর্থ আত্মসাৎকারী প্রতারক চক্রের হোতা। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায়। বাবার নাম মোস্তফা কামাল ওরফে ফুল মিয়া।
আবু হানিফ তুষারকে গ্রেপ্তারের সময় একটিটি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, অ্যামুনিশন, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত গাড়ি, বিভিন্ন ভিডিও এবং এডিট করা ছবি জব্দ করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি প্রতারণায় সম্পৃক্ততার বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আবু হানিফ দীর্ঘদিন ধরেই প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের নিকটাত্মীয় পরিচয়ে নানামুখী প্রতারণা করে আসছিলেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন সংসদীয় আসনে মনোনয়নপ্রাপ্তির মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ দাবি করেন তিনি। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন ও পদোন্নতি, সরকারি চাকরির প্রলোভন দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেন তিনি।
র্যাব জানায়, এই প্রতারক দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন বেনামি মোবাইল নম্বর প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নামে মোবাইলে সেভ করে রাখতেন। পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন অ্যাপস থেকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য সেজে নিজেই অথবা চক্রের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে ম্যাসেজ আদান-প্রদান করতেন।
চ্যাটিংয়ে তারা আসন্ন সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাইয়ে দেয়া, পদায়ন ও পদোন্নতি, চাকরি দেয়া ও বিভিন্ন অংকের অর্থ দাবি সংক্রান্ত বার্তা আদান-প্রদান করতেন। আর টার্গেটের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিজের ছবি এডিট করে বসাতেন। এভাবে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সুসর্ম্পক থাকার দাবি করে তা টার্গেট করা ব্যক্তিকে পাঠাতেন। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে টার্গেট করা ব্যক্তিকে দেখাতেন অথব পাঠিয়ে দিতেন।
তুষারকে জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, সংসদ নির্বাচনে যাদের মনোনয়নপ্রাপ্তির সম্ভাবনা দোদুল্যমান বা ক্ষীণ, তাদেরকে টার্গেট করতেন করতেন এই প্রতারক। পরবর্তীতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মনোনয়ন পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে মোটা অংকের অর্থ দাবি করতেন। ক্ষেত্রবিশেষে দামি গাড়িতে চড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে দামি হোটেলে টার্গেটকৃত ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। তিনি বিভিন্ন সংসদীয় আসনে মনোনয়ন পাইয়ে দেয়ার জন্য দুশ’ থেকে তিনশ’ কোটি টাকা দাবি করতেন।
এছাড়াও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন বা পদোন্নতির মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছে বিপুল অংকের অর্থ দাবি করতেন এই প্রতারক। এভাবে তিনি বিভিন্নজনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।
জিজ্ঞাসাবাদে আবু হানিফ জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত তিনি প্রতারণার মাধ্যমে ৩০ জনের বেশি ব্যক্তিকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন।
এভাবে নানামুখী প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ কোটি টাকার বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
আবু হানিফ বাস্তবে এইচএসসি পাস হলেও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন বলে মিথ্যা পরিচয় দিতেন। তিনি ২০০৮ সালে মোটর পার্টসের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হন।
পরিবহণ সেক্টরে দেশের বিভিন্ন রুটে ‘তুষার এন্টারপ্রাইজ পরিবহন’ নামে তার বেশ কয়েকটি বাসও রয়েছে। চড়েন নিজের ব্যক্তিগত গাড়িতে। রাজধানীর নাখালপাড়া ও ধানমন্ডি এলাকায় দলীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন বলে মিথ্যা প্রচার চালাতেন তিনি।
এই প্রতারক ২০১৪ সাল-পরবর্তী সময়ে একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রতারণা শুরু করেন।
জানা যায়, প্রতারণার মাধ্যমে তিনি বিপুল পরিমাণ জমি ও সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক সংক্রান্ত বিষয়ে একাধিক মামলা রয়েছে এবং ওইসব মামলায় একাধিকবার কারাগারে গেছেন।