ঠাকুরগাঁওয়ের সুক নদীর বুড়ির বাঁধ। প্রায় শত বছর ধরে এই বাঁধে উদযাপন হয়ে আসছে মৎস্য উৎসব। বছরের একটি দিনে এই উৎসবের আমেজে স্থানীয়দের মিলন মেলায় পরিণত হয় পুরো এলাকা।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এই উৎসব পালনের ইতিকথা। তারা জানান, শুষ্ক মৌসুমে কৃষি জমিতে সেচ সুবিধার জন্য ১৯৫১-১৯৫২ অর্থবছরে সদর উপজেলার সুক নদীর ওপর বুড়ির বাঁধ নামে একটি জলকপাট নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৭-১৯৭৮ অর্থবছরে বাঁধের আশপাশে সেচ খালও নির্মাণ করা হয়।
সুক নদীর জলকপাটে আটকে থাকা পানিতে মৎস্য অধিদপ্তর প্রতি বছর বিভিন্ন জাতের মাছের পোনা অবমুক্ত করে। পরে বাংলা কার্তিক মাসের শুরুর দিনে সেসব মাছ শিকার সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। প্রায় শত বছর ধরে বাঁধের জলে মাছ ধরার উৎসবের এই রেওয়াজ চলে আসছে ঠাকুরগাঁওয়ে। আর সেই রেওয়াজে যোগ দেন হাজারো মানুষ।
এ বছরও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার দিনভর এই বাঁধ এলাকায় চলে মৎস্য উৎসব।
তবে উৎসবে আসা জেলে ও শখের মাছ শিকারিদের ক্ষোভ ও হতাশার ভারে অনেকটাই মলিন ছিল এবারের মৎস্য উৎসবের আমেজ।
উৎসব নিয়ে সর্বসাধারণ যা বলছেন
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সব ইউনিয়নের মানুষ এই জলকপাটে আসেন মাছ ধরতে। দিনটিকে উপভোগ করতে ছুটে আসেন দূর-দূরান্তের মানুষও। তাদের মাঝেই কয়েকজন জেলে ও মাছ ধরতে আসা স্থানীয়দের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
সদর উপজেলার ভুল্লী বাজার থেকে মাছ ধরতে এসেছেন হাসান আলী। কয়েক ঘণ্টা ধরে টানা জাল ফেলেও হতাশ হতে হয় তাকে। ২৫০ গ্রাম মাছও ওঠেনি তার জালে। অবশেষে জাল গুটিয়ে নেন তিনি।
আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘এই উৎসব আর আগের মতো নেই। এখানে আর সাধারণ মানুষ মাছ ধরতে আসবে না। কারণ বাঁধের আশপাশে যাদের জমি রয়েছে তারা চারদিকে ঘিরে খাবার দিয়ে মাছ আটকে রেখেছে। এছাড়া বাঁধের পানিতে শত শত নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করা হচ্ছে। এমন করে চলতে থাকলে এই উৎসব একদিন হারিয়ে যাবে।’
সোমবার রাত ১১টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত মাছ শিকারে বাঁধে সময় কাটান রাসেল ইসলাম। জানালেন, এখন পর্যন্ত ৩০০ টাকার খাবার কিনে খেয়েছেন তিনি। অথচ কোনো মাছ পাচ্ছেন না।
অভিযোগের সুরে তিনি বললেন, ‘মাছগুলো ঘেরে আটকে দেয়া হয়েছে। এখানে মৎস্য উৎসবের চেয়ে তামাশা চলছে বেশি। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখেন চারদিকে ঘের দিয়ে রেখেছে প্রভাবশালীরা। খাবার দিয়েছে ঘেরে। আমরা যারা দূর থেকে মাছ ধরতে এসেছি তারা এখানে বেকার সময় নষ্ট করছি।’
ঢাকা থেকে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে মাছ ধরা ও আয়োজন দেখতে এসেছেন স্থানীয় হাফিজুল ইসলাম।
বর্তমান পরিস্থিতি দেখে তিনি বলেন, ‘উৎসবটি আর ঐতিহ্যবাহী মৎস্য উৎসব নেই; ব্যক্তি উৎসবে পরিণত হয়েছে। সামাজিকভাবে এর সমাধান দরকার। নয়তো একদিন এই উৎসব হারিয়ে যাবে।
‘ছোটবেলা থেকেই এখানে উৎসব দেখে বড় হয়েছি। এই অঞ্চলের ঐতিহ্যের সঙ্গে দিনটি মিশে আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখানে আগের মতো ভাতৃত্ববোধটুকুও নেই। আগে এমন ঘের ছিলো না। উন্মুক্তভাবে মাছ শিকার করতাম আমরা। এখন এখানে ঘের দেয়া হয়েছে। সীমানা ভাগ করে এক প্রকার দখল নেয়া হয়েছে, যেটি ভাতৃত্ববোধের ওপর আঘাত।’
মাছ কেন পাচ্ছেন না স্থানীয়রা- জানতে চাইলে স্থানীয় আবু বকর বলেন, ‘সারা বছর নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ শিকার করা হয়। এখন আবার ঘের দিয়ে মাছ আটকে রেখেছে প্রভাবশালীরা। আমরা যেখানে জাল ফেলছি এখানে হাজার হাজার জাল পড়ছে। এখানে পানিও অনেক; তবে মাছ নেই। বাঁধের আশপাশে যাদের জমি আছে এ উৎসব শুধু তাদের জন্যই বলে মনে হচ্ছে এখন। এখানে আমাদের কিছুই বলার নেই।
‘কোনো জমির মালিক এখানে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করেনি। তাহলে কেন তারা ঘের দেবেন আর মাছ আটকে রাখবেন? এটি সমাজে নৈতিকতার চরম অবক্ষয়। গত কয়েক বছর ধরে এই সমস্যা লক্ষ্য করছি। আমরা এর সমাধান চাই।’
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যা বলছেন
ঠাকুরগাঁও মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই মৌসুমে রুই, কাতলা, মৃগেলসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় তিন কেজি মাছের পোণা অবমুক্ত করা হয়েছিল বুড়ির বাঁধের অভয়াশ্রমে।
সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আয়েশা আক্তার বলেন, ‘আমরা নিষিদ্ধ জালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছি। তবুও স্থানীয়দের মাঝে সচেতনতা কম থাকায় বেশকিছু মাছ নিধন হয়েছে।’
ব্যক্তিগত জমির ঘেরে মাছ আটকে রাখার বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. খালিদুজ্জামান বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে আমরা এ সমস্যা লক্ষ্য করছি। ব্যক্তিমালিকানার কিছু জমিতে ঘের দিয়ে মাছ আটকে রাখা হচ্ছে এবং তারা বলছে তারাও ব্যক্তিগতভাবে মাছ চাষ করছে। অথচ জমিগুলো আবাদি। এখানে আইনি কিছু করার সুযোগ থাকলে অবশ্যই আমরা সে প্রক্রিয়ায় এগুবো। প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে কথা বলব।’