২০১৫ সালের ৭ মে সকাল সাড়ে ১০টা। চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া দুই ভাই হৃদয় ও রিয়াদ তখন ক্লাসে। হঠাৎ খবর আসে- বাসায় একটা সমস্যা হয়েছে, দ্রুত যেতে হবে। শিশু দুটি তখনও কিছু আঁচ করতে পারেনি। দ্রুত এক কিলোমিটার দূরে সদরঘাট থানার দক্ষিণ নালাপাড়ার বাসার উদ্দেশে ছোটে দুই ভাই।
বাসার নিচে পৌঁছেই ওরা দেখতে পায় মানুষের ভিড়। স্থানীয় লোকজন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জটলা। বাসায় প্রবেশ করে দেখে স্বজনরা আহাজারি করছেন। আর ড্রয়িংরুমের মেঝেতে পড়ে আছে মায়ের গলাকাটা রক্তাক্ত মরদেহ।
বাথরুমে পড়ে আছে ফাল্গুনীর নিথর দেহ। আদরের একমাত্র ছোট বোনটিরও গলাকাটা। দু’জনের রক্তে ভেসে গেছে ড্রয়িংরুম ও বাথরুমের মেঝে।
ঘণ্টা দুয়েক আগেও হৃদয় ও রিয়াদকে ঘুম থেকে ডেকে হালুয়া-পরোটা খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন মা। ছোট বোন ফাল্গুনী ছিল ঘুমে।
ঘটনার আকষ্মিকতায় সেদিন মুষড়ে পড়েছিল দুই শিশু। মা ও বোনকে হারানোর শোকে কাঁদতেও ভুলে যায় ওরা। ধপ করে বসে পড়ে পাশের খাটে। সে সময় ওদের সঙ্গে ছিলেন দূর সম্পর্কীয় চাচা মো. বেলাল হোসেন। এই বেলাল সেদিন চারতলার ওই ফ্ল্যাটে পাশে বসে স্বজনহারা শিশু দুটিকে সান্ত্বনার বাণী শোনান।
স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাসন্তানকে কেড়ে নিয়েছে ঘাতকের ছুরি। শাহ আলমের এই সুখের সংসার আজ শুধুই স্মৃতি। ফাইল ছবি
বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে দীর্ঘ ৯ বছর পর ওই মা-মেয়ে হত্যার মামলার রায় হয়েছে বৃহস্পতিবার। রায়ে ঘটনার দিন হৃদয়-রিয়াদের সঙ্গে খাটে বসে থাকা বেলালের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।
আদালতের রায়ের খবরটিও সেদিনের মতোই ক্লাসে বসে জানতে পারেন রিয়াদ হোসেন। তবে সেদিনের মতো স্কুলের বেঞ্চিতে বসে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে।
সময় পরিক্রমায় রিয়াদ এখন বড় হয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগে লেখাপড়া করেন তিনি। আর তার বড় ভাই হৃদয় হোসেন এলাকায় ব্যবসা করেন।
রিয়াদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রায় শুনে খুব খুশি হয়েছি। এখন আমাদের চাওয়া- রায়টা দ্রুত কার্যকর করা হোক।’
তিনি বলেন, ‘এখন একটু বড় হয়েছি। অনেক কিছুই আজ বুঝতে পারি। তখন (ঘটনার সময়) ছোট ছিলাম, কিছুই বুঝতাম না। আম্মু থাকলে জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। তবে আলহামদুলিল্লাহ, আব্বু সবকিছু পূরণের চেষ্টা করেন। কিন্তু মা তো মা-ই; মায়ের অভাব কখনোই অন্য কিছুতে পূরণ হয় না।’
আসামি বেলালের উল্লেখ করে রিয়াদ বলেন, ‘আমার মা-বোনকে খুন করে লোকটা স্বাভাবিক মানুষের মতো আমাদের সঙ্গেই বসে ছিল। কত বড় অমানুষ হলে কেউ এমন আচরণ করতে পারে! তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, এটাই চাওয়ার ছিল।’
বাবার সঙ্গে দুই ছেলে হৃদয় ও রিয়াদ। ফাইল ছবি
যা ঘটেছিল সেদিন
সদরঘাটে দক্ষিণ নালাপাড়ায় মোবাশ্বের মিয়ার বাড়ির চতুর্থ তলার ওই বাসা থেকে ছাগলের মাংস ব্যবসায়ী শাহ আলমের স্ত্রী নাছিমা বেগম ও তার ১০ বছর বয়সী কন্যা রিয়া আক্তার ফাল্গুনীর গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
এ ঘটনায় সদরঘাট থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা করেন নাছিমার স্বামী শাহ আলম। মামলায় হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি নগদ ১ লাখ ১১ হাজার টাকা ও ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার স্বর্ণালঙ্কার লুটের কথা উল্লেখ করা হয়। সেই মামলার তদন্তে নেমে হিমশিম খান সদরঘাট থানার তৎকালীন পরিদর্শক মর্জিনা আক্তার। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে কোনো তথ্যই পাওয়া যাচ্ছিলো না।
পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান তৎকালীন নগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের পরিদর্শক সৈয়দ আব্দুর রউফ৷ তদন্তে নেমে প্রতিবেশী ও সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি শাহ আলমের সঙ্গেও নতুন করে কথা বলেন তিনি।
এই পর্যায়ে তিনি জানতে পারেন যে নগদ টাকা আর স্বর্ণালংকার ছাড়াও সেদিন দুটি মোবাইল ফোন ওই বাসা থেকে লুট হয়। সেই মোবাইলের সূত্র ধরে মূল আসামিকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের পর একই বছরের নভেম্বরে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন তিনি। পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে আদালত প্রতিবেদনটি গ্রহণ করে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় মো. বেলাল হোসেন নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার বেলাল নিহত নাছিমা ও ফাল্গুনীকে হত্যা করে লুট করা স্বর্ণালঙ্কার নগরীর কালামিয়া বাজারে মৌমিতা জুয়েলার্সে বিক্রির কথা জানান।
পরবর্তীতে বেলালের দেখানো মতে মৌমিতা জুয়েলার্সের কর্মচারী টিটু সাহাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি কেনার পর ওই স্বর্ণালংকার গলিয়ে নতুন স্বর্ণালংকার তৈরির কথা জানান। তাছাড়া লুট করা দুটি মোবাইল সেটের একটি নিজের কাছে রেখেছিলেন বেলাল। অন্যটি উপহার দিয়েছিলেন বান্ধবীকে।
মো. বেলাল হোসেন সম্পর্কে শাহ আলমের খালাতো ভাই৷ ঘটনার তিনদিন আগে নিজের মাংসের দোকানের টিউবওয়েল মেরামতের জন্য বেলালকে ডেকে বাসায় নেন শাহ আলম। পরদিন টিউবওয়েল মেরামতের সময় দুপুরের খাবারের জন্য শাহ আলমের সঙ্গে বাসায় যান বেলাল। সেখানে আলমারি থেকে টাকা নিয়ে নাছিমা তার স্বামী শাহ আলমকে দেয়ার সময় বিষয়টি খেয়াল করেন বেলাল। পরবর্তীতে ওই টাকা লুটের পরিকল্পনা করে তিনি।
পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজের ফাঁকে শাহ আলমের মাংসের দোকান থেকে একটি ধারালো ছুরি নিয়ে পাশ্ববর্তী ডাস্টবিনে রাখেন বেলাল।
৭ মে সকালে শাহ আলমকে দোকানে দেখে ডাস্টবিন থেকে ছুরিটি শরীরের পেছনে লুকিয়ে বাসার সামনে যান বেলাল। সেখানে দাঁড়িয়ে শাহ আলমের ১৪ ও ১২ বছর বয়সী দুই ছেলে হৃদয় হোসেন ও রিয়াদ হোসেন স্কুলের উদ্দেশে বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি।
হৃদয় ও রিয়াদ বেরিয়ে যাওয়ার পর বাসায় প্রবেশ করে নাছিমাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করেন বেলাল। এসময় ফাল্গুনী এগিয়ে এলে তাকেও কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করেন তিনি। পরে ওই বাসায় হাত-মুখ ধুয়ে আলমারি থেকে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে পালিয়ে যান।
হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পর স্বজনদের সঙ্গে শাহ আলমের বাসায় এসে নিহতদের মরদেহ ভবন থেকে নিচে নামানোসহ বিভিন্ন কাজে অংশ নেন বেলাল।
সেদিনের শিশু রিয়াদ বড় হয়েছেন। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ছবি: নিউজবাংলা
বেলালের মৃত্যুদণ্ড ও টিটুর ৩ বছরের জেল
নাছিমা ও তার মেয়ে ফাল্গুনীকে গলাকেটে হত্যার ওই মামলায় বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করেন চট্টগ্রামের ষষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ বেগম সীরাজম মুনিরা। আদালতের বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ সাগর রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি দীর্ঘতম বড়ুয়া দীঘু বলেন, ‘মর্মান্তিক ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলার রায়ে মো. বেলাল হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। তাছাড়া লুট করা মালামাল কেনায় স্বর্ণের দোকানের কর্মচারী টিটু সাহাকে ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছে আদালত। দণ্ডের অর্থ অনাদায়ে আরও তিন মাসের জেল দেয়া হয়েছে।’
রায়ের আদেশ নিয়ে স্ত্রী-কন্যার কবরের পাশে যাবেন শাহ আলম
নিহত নাছিমার স্বামী শাহ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার স্ত্রী-কন্যা বলে বলছি না, ঘটনার মর্মান্তিকতা সেদিন উপস্থিত সবাইকে ছুঁয়ে গেছে। পুরো এলাকার মানুষ কেঁদেছে। আবার আজ (বৃহস্পতিবার) রায় শুনে এলাকার গাছপাতা পর্যন্ত খুশি।’
তিনি জানান, নিহত স্ত্রী-কন্যাকে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে সমাহিত করা হয়। আসামির মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার রায়ের কপি ও অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে দুই ছেলেসহ মুরাদনগরের পূর্ব ধইর এলাকায় নিজেদের পারিবারিক কবরস্থানে স্ত্রী ও কন্যার কবর জিয়ারতে যাবেন তিনি।