কৃষিতে যেসব বিষয় নতুন উদ্ভাবিত হচ্ছে, সেটা কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিআরসি) চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার।
কিশোরগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে বৃহস্পতিবার দুপুরে ‘হাওরাঞ্চলের কৃষির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিআরআই উদ্ভাবিত জাত ও প্রযুক্তির বিস্তার’ শীর্ষক গবেষণা-সম্প্রসারণ-কৃষক সন্নিবদ্ধ কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথাগুলো বলেন।
কৃষকের দোরগোড়ায় আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি পৌঁছে দিতে ভূমিকা রাখার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশটা আমাদের। অনেক রক্ত ও কষ্টের বিনিময়ে এ দেশটা স্বাধীন হয়েছে। আমরা সাহেব হয়েছি। ঢাকা থেকে পাজেরো গাড়িতে চলে আসতে পারি। আমরা সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় বেতন পাই, এই বোধটুকু সকলের থাকতে হবে।
‘একটা দেহ ব্যবসায়ী, ভিক্ষুক, মুচি তার পয়সায় আমি সাহেব। এটা ধারণ করতে হবে। অফিসার চুরি করার জন্য নয়, অফিসার মানেই সম্পদের অপব্যবহারের জন্য নয়। বাংলাদেশে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য কাজ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমি বিআরসির ২৪তম চেয়ারম্যান। আমার আগে ২৩ জন চেয়ারম্যান ছিলেন। আমকে যত লোক দেখেছে, এর আগের ২৩ জন চেয়ারম্যানকে তত লোক দেখেনি। মাঠ পর্যায়ের খোঁজ খবর রাখা, মাঠ পর্যায়ে যাওয়া এটা আমার দায়িত্ববোধ থেকেই করি। গবেষণার প্রধান হয়ে যদি আমি মাঠ পর্যায়ের খবর না রাখি, তবে এ পদে থাকার কোন মানে হয়না।’
বিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশে ৫০ বছরের ইতিহাসে যদি উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য থাকে সেট কৃষিক্ষেত্রে। এর একটি কারণ হলো সরকারের সদিচ্ছা। রাজনৈতিক সরকারের একটা কমিটমেন্ট ছিল যে, আমরা বাংলাদেশকে খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত করতে হবে।
‘আরেকটি বিষয় ছিল আমাদের প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি থাকলেই হবেনা। এই প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ের কৃষকরা যাতে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে, সেজন্য কৃষকদেরকে প্রচুর পরিমাণে সহায়তা দেয়া হয়েছে। সার, বীজ, সেচসহ বিভিন্ন খাতে প্রচুর পরিমাণে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। হাওর অঞ্চলে ২৫ লাখ টাকা দামের কম্বাইন হার্ভেস্টার যন্ত্র ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষকদেরকে দেয়া হচ্ছে। আর সমতলে ২৫ লাখ টাকার যন্ত্র দেয়া হচ্ছে ১২ লাখ টাকায়। এর উদ্দেশ্য হলো প্রযুক্তি যাতে মাঠ পর্যায়ে যায় এবং কৃষক যাতে লাভবান হয়।’
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর পর আমরা খাদ্যের অভাব দেখেছি। তখন বিঘাপ্রতি ধান উৎপাদন হতো ৬ থেকে ৮ মণ। সে তুলনায় এখন তিনগুণ বেশি উৎপন্ন হয়। আজকে সারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এরমধ্যে আমরাও আছি।
‘কৃষিবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ভূমিকার কারণেই করোনা মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং জলবায়ুর প্রচণ্ড পরিবর্তনের মাঝেও বাংলাদেশে কেউ না খেয়ে মারা যায়নি। এটা আমাদের বড় ধরণের অর্জন। এক্ষেত্রে দেশের কৃষি বিজ্ঞানী এবং মাঠ পর্যায়ের সম্প্রসারণ কর্মীদের ভূমিকা প্রশংসনীয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধুমাত্র শস্যের ওপর ভিত্তি করে প্রধানমন্ত্রী সাত হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প আমাদেরকে দিয়েছেন। এটার মাধ্যমে কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। বাংলাদেশে যে খাদ্য উৎপাদন হয়, সেটা দিয়ে আমরা পেট ভরতে পারি। কিন্তু আমরা পুষ্টিনির্ভর খাবার খেতে চাই। মানুষের খাবারেও পরিবর্তন এসেছে। দেশ যত উন্নত হবে, মানুষ ততই বৈচিত্র্যময় খাবারের প্রতি ঝুঁকবে। যে পরিবর্তন আসবে, তার সঙ্গে আমাদেরকে খাপ খাইয়ে চলতে হবে।’
ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বান অনুযায়ী আমদের এক ইঞ্চি জমিও পতিত রাখা যাবেনা। আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে। সেজন্য কৃষিতে যেসব বিষয় নতুন উদ্ভাবিত হচ্ছে, সেটা কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে।’
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআই) মহাপরিচালক ড. দেবাশীষ সরকার বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেককেই নিজেদের জায়গা থেকে চ্যাম্পিয়ন হবো, এই মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের উদ্ভাবিত জাত ও প্রযুক্তিগুলো কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তারাও তাদের জায়গা থেকে চ্যাম্পিয়ন হবে।’
এর আগে বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা কৃষক প্রতিনিধিরা তাদের সাফল্য, সম্ভাবনা এবং সমস্যার কথা তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন।
কর্মশালায় বিশেষ অতিথি ছিলেন কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (সেবা ও সরবরাহ) পরিচালক ড. ফেরদৌসী ইসলাম, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (গবেষণা) পরিচালক ড. মো. আব্দুল্লাহ ইউছুফ আখন্দ, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন) পরিচালক ড. দিলোয়ার আহমদ চৌধুরী, কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সদস্য পরিচালক ড. মো. আবদুছ ছালাম ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক এস এম সোহরাব উদ্দিন।
কর্মশালায় কারিগরি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআরআই সরেজমিন গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. রবিউল আলম ও কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) আনোয়ার হোসেন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বিআরআই কিশোরগঞ্জের সরেজমিন গবেষণা বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দীন, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. ইয়াছিনুল হক রায়হান, জেলা কৃষক লীগের সভাপতি আহমেদ উল্লাহ, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিলকিছ বেগম প্রমুখ।
বিআরআই কিশোরগঞ্জ এর সরেজমিন গবেষণা বিভাগ এ কর্মশালার আয়োজন করে। এতে কৃষি কর্মকর্তা, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও কৃষক প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।