চট্টগ্রামে পুলিশি হেফাজতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অবসরপ্রাপ্ত উপপরিচালক ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লার মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পরিবার বলছে, এটি পরিকল্পিত হত্যা।
মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে নগরের চানগাঁও থানায় ৬৭ বছর বয়সী এই ব্যক্তির মৃত্যুর পর এর বাইরেও বেরিয়ে এসেছে বেশ কিছু তথ্য। পরিবারের দাবি, যে মামলায় গ্রেপ্তারের পর তিনি মারা যান, এটি ছিল ভুয়া মামলা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্ত্রীর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমিতে ভবন নির্মাণের কাজ করছিলেন সাবেক এ দুদক কর্মকর্তা। সেখান থেকে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের চেষ্টা করেন স্থানীয় কথিত রাজনৈতিক নেতা মো. জসিম উদ্দিন।
ব্যর্থ হয়ে চাঁদা আদায়ের শেষ চেষ্টা হিসেবে নগরীর কল্পলোক আবাসিক এলাকার এক গৃহবধূকে শহীদুল্লার গৃহকর্মী সাজিয়ে মামলা করেন ওই জসিম। সেই মামলাতেই মঙ্গলবার রাতে আদালতের পরোয়ানার ভিত্তিতে শহীদুল্লাকে গ্রেপ্তার করে চান্দগাঁও থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারের কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়।
অভিযুক্ত জসিম উদ্দিন রাউজানের গৈয়া মোহাম্মদের বাড়ি এলাকার শামসুল আলমের ছেলে। বর্তমান চান্দগাঁও থানার এক কিলোমিটার এলাকায় বসবাস তার।
পরিবারের অভিযোগ, গ্রেপ্তারের পর শহীদুল্লার কাছে ওষুধ ও ইনহেলার পৌঁছাতে দেয়নি পুলিশ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে মামলায় শহীদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সেই মামলায় আসামি ছিলেন তিনি ও তার শ্যালক মোহাম্মদ কায়সার আনোয়ার। মামলাটি করেছেন রণি আক্তার তানিয়া নামের এক নারী।
নিজেকে শহীদুল্লার গৃহকর্মী দাবি করে মামলার এজাহারে পাওনা বেতনের সাড়ে ৬ হাজার টাকা চাইতে গেলে আসামিরা তাকে মারধর, হত্যাচেষ্টা, হুমকি ও তার শালীনতা ক্ষুণ্নের চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ এনেছেন তিনি।
প্রাণ হারানো ব্যক্তির পরিবারের দাবি, তাদের বাসায় গত দুই বছর ধরে কোনো গৃহকর্মী নেই। দুই বছর আগে মুক্তা নামের এক তরুণী ছিলেন, তার বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন তারা। এমনকি পরিবারের কেউই গৃহকর্মী দাবি করা রণি আক্তার তানিয়া নামের ওই নারীকে চেনেন না।
শহীদুল্লার স্বজনদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রণি আক্তার তানিয়া নামের ওই নারীর পরিচয় জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। মামলার এজহারে উল্লেখ করা ফোন নম্বরের সূত্র ধরে ওই নারী ও তার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। শুরুতে মুখ না খুললেও পরবর্তী সময়ে জসীম নামের এক কথিত রাজনৈতিক নেতা ও তার আইনজীবী সাদেক উদ্দিনের প্ররোচনায় নিজেকে শহীদুল্লার গৃহকর্মী দাবি করে মামলাটি করার কথা জানান রণি আক্তার।
রণি আক্তার নিউজবাংলাকে জানান, ঘটনার শুরু মাস দুয়েক আগে। তিনি সন্তানসহ তিন চাকার ছোট্ট গণপরিবহন ম্যাক্সিমা চালক স্বামী মো. সোহেলের সঙ্গে নগরীর বাকলিয়া থানার কল্পলোক আবাসিক এলাকায় বসবাস করতেন। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধগতির কারণে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে সোহেল এক বন্ধুর মাধ্যমে চাদগাঁও থানার এক কিলোমিটার এলাকায় বিনা ভাড়ায় একটি বাসায় বসবাসের প্রস্তাব পান। এর বাইরেও বাসার মালিক প্রতি মাসে তাদের কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে দেয়ার কথাও জানান।
তখন তাদের বিনা মূল্যে থাকার জন্য নির্ধারিত বাসাটি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা জসিমের বলে জানতে পারেন তারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে ওই বাসায় প্রবেশ করেন তারা। ওই দিন দুপুরেই পুলিশ এসে তাদের নাম ঠিকানা লিখে নিয়ে যায়। পুলিশ আসায় দুজনেই ভয় পেয়ে যান।
রণি আক্তার জানান, বাসায় কোনো সমস্যা আছে ভেবে পরদিন সকালেই ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা। কিন্তু এরমধ্যে ওই দিন সন্ধ্যায় স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। চারদিন কারাগারে থাকার পর তাদের জামিনে মুক্ত করেন জসিম। কিন্তু বাসায় গিয়ে দেখেন দুটো খাটসহ অন্যান্য আসবাবপত্র ও সামগ্রী লুট হয়ে গেছে৷
তিনি জানান, বিষয়টি জসিমকে জানালে তিনি দুটো বিছানাপত্র ও চারটা পাতিল কিনে দেন তাদের। এরমধ্যে তারা জানতে পারেন তাদের জিনিসপত্র মূলত বাসার পার্শ্ববর্তী শহীদুল্লাহ নামের একজনের স্ত্রী নিয়ে গেছেন। শহীদুল্লাহ বাসায় ওই জিনিসপত্রের জন্য তানিয়ার স্বজনরা গেলে খারাপ ব্যবহার করেন তার স্ত্রী। পরবর্তীতে একবার আদালতে হাজিরা দিতে গেলে জসিম তাদের ৫০০ টাকা গাড়িভাড়া হিসেবে দেন।
রণি আক্তার তানিয়া বলেন, ‘খরচ কমিয়ে সুখে দুটা ডালভাত খাওয়ার জন্য ওই বাসায় উঠেছিলাম। কিন্তু উল্টো আমার সব জিনিসপত্র হারালাম। জসিম আমার জিনিসপত্র নিয়ে দেবে বলছে, তারে ফোন করলে ঝাড়ি দেয়, রিসিভ করে না। এরপর একদিন সে বললো শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা করতে। আমরা রাজি না হওয়ায় সে বলছে, মামলা না করলে জিনিসপত্র ফিরে পাব না। এরমধ্যে একদিন জসিম ও তার আইনজীবী আদালতে ডেকে মামলা করার কথা জানায় আমাদের। সেখানে যা যা লিখছে ২০ থেকে ২৫ মিনিট ধরে আমাকে মুখস্থ করাইছে। পরে বিচারকের সামনে গিয়ে দাঁড়াইছি, আমার কাছ থেকে সাইন নিছে। আর কিছু করতে হয়নি।’
পরবর্তীতে কয়েকদিন আগে ফের জসিমের সহযোগী লিটন ও আইনজীবী সাদেক তাদের ফোন করে আদালতে যেতে বললেও এখনো লুট হওয়া জিনিসপত্র না পাওয়ায় রাগ করে আর যাননি বলে জানান তিনি।
রণি আক্তার আরো বলেন, “সকালে আমাকে লিটন ফোন করে বলছে শহীদুল্লাহকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর মরে গেছে। আমি যেন মোবাইলের সিম বন্ধ করে বাড়িতে (বাঁশখালী) চলে যাই৷ আমি বলছি, ‘না, আমি কেন এটা করব? আমার জিনিস তো পাইনি। আমার দোষ নাই। আমি কোথাও যাব না।’ এটা বলার পর সে বলছে তাহলে আমাদের সমস্যা হলে তাদের দোষ নাই।”
‘আমি সত্যটা বলে দিছি সবাইকে। শহিদুল্লাহ সম্পর্কে আমি জানতাম না। সবাই বলতেছে িউনি অনেক ভালো লোক, নিরীহ।’
তিনি বলেন, ‘শহীদুল্লাহর বাসায় আমি কখনে যাইনি। তবে প্রথমবার আমাদের যখন ধরে নিয়ে গেছে তখন আদালতে দেখেছি। আমার স্বামী কখনো দেখেনি।’
নিহত শহীদুল্লাহর ছেলে ক্যাপ্টেন নাফিস শহিদ বলেন, ‘আমরা মায়ের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পত্তিতে ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। মূলত জসিম তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে আমার বাবার কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছিল, আমরা রিফিউজ করেছি। কেন তাকে টাকা দেব? এজন্য সে আমাদের বাইরে থেকে লোক বসিয়ে দিয়ে বাসা দখলের চেষ্টা করেছিল।
‘শুরুতে কিছু মেয়েকে বাসায় নিয়ে এসেছিল। আমাদের মারামারিতে যাওয়ার মানসিকতা নেই, তাই থানায় অভিযোগ করেছিলাম। আর বাসায় দখলকারীর যে মালামাল তার কিছু অংশ জসিমের সহযোগী আরেক জসিমের বোন নিয়ে গেছে। খাটসহ কিছু কিছু আমাদের বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে, এখনে নিচে পড়ে আছে।’
‘তবে ওই নারীকে আমরা কেউ চিনতাম না। এই নামের কারো নামই কখনো শুনিনি আমরা কেউই। আমরা পুরো বিষয়টার সুষ্ঠু তদন্ত চাই।’
এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে জসিম, জসিমের সহযোগী লিটন ও আইনজীবী সাদেক উদ্দিনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগোর চেষ্টা করেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।
এর আগে মঙ্গলবার রাতে নগরীর চান্দগাঁও থানার এক কিলোমিটার এলাকার বাসার সামনে থেকে দুদকের সাবেক উপপরিচালক ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর থানায় নেয়া হলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে দাবি পুলিশের।পরবর্তীতে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) মহাসচিব জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘সাধারণত বাদী সাইন করলে তার দায় বাদীর হয়ে যায়। তবে বাদী যদি অভিযোগ করেন যে তিনি যা বলেননি তা এজহারে লিখেছেন আইনজীবী, সেক্ষেত্রে আইনজীবী সমিতি ব্যবস্থা নিতে পারবে।’