ভারতের সিকিমে তিস্তা নদীর ওপর দেয়া বাধ ভেঙে গিয়ে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের পাঠানো সংবাদের পর সীমান্ত জেলা লালমনিরহাটসহ কুড়িগ্রাম, রংপুর, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলার নিম্নাঞ্চলগুলোতে বন্যার সতর্কতা জারি করেছে প্রশাসন।
বুধবার সকালে দেশের নদ-নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
বিজ্ঞপ্তিতে ভারতীয় কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের (সিডাব্লিউসি) বরাতে পাউবো জানায়, সিকিম রাজ্যে তিস্তা নদীর ওপর চুংথাং ড্যাম (বাধ) ভেঙে যাওয়ায় তিস্তার পানি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার তিস্তা বাধের দোয়ানী পয়েন্টে পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। বুধবার সকাল ছয়টার দিকে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৮০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও বিকেল তিনটার দিকে তা বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার নিচে উঠেছে।
গত কয়েকদিন ধরে ভারতের সিকিমে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে ওই বাধে ভাঙন দেখা দিয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তি জানায় পাউবো।
এদিকে ভারতীয় আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় সিকিমে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা থাকায় আরও পানি বৃদ্ধির সম্ভবনা রয়েছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে ভারতের গজল ডোবা পয়েন্টে পানির উচ্চতা প্রায় ২৮৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ১১০.৩০ মিটার এবং দোমুহুনী পয়েন্টে আজ সকাল থেকে প্রায় ৮২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে তা ৮৫.৯৫ মিটার হয়েছে।
এর ফলে লালমনিরহাটসহ উত্তরাঞ্চলের সীমান্তের জেলাগুলোতে নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বাপাউবো।
ভারত অংশে বাধ ভেঙে যাওয়ায় উজানের পানি যেকোনো মুহূর্তে বাংলাদেশ অংশে ঢুকে পড়বে এবং তা বিপৎসীমার অন্তত ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার আশংকা করছেন বাপাউবো কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় তিস্তার পাহাড়ি ঢল নেমে আসলে বাংলাদেশের লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলার নিম্নাঞ্চলসহ আশপাশের এলাকাগুলো প্লাবিত হবার সম্ভবনা রয়েছে এবং এ ঘটনায় বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
তিস্তা নদীর দুই পাড়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত ও বন্যার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় বুধবার জেলা প্রশাসনের নির্দেশে হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, আদিতমারী, পাটগ্রাম ও লালমনিরহাট সদর উপজেলায় ইতোমধ্যে মাইকিং করে সতর্কর্তা জারি করা হয়েছে।
পাউবোর তিস্তা ব্যারেজ সহকারী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, ভারতে সিকিমে বাধ ভাঙ্গার কারণে নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।’
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদউল্লাহ বলেন, ‘বন্যার আশঙ্কায় আমরা তিস্তা তীরবর্তী এলাকাগুলোতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি, যাতে মানুষের জানমাল রক্ষা করা যায়। এ ছাড়াও তাদের জন্য তাৎক্ষণিক শুকনো খাদ্যসামগ্রীও পর্যাপ্ত মজুদ রাখা হয়েছে। আশা করি, বড় কোনো সমস্যা হবে না। পাশাপাশি নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোতে মাইকিং করে সতর্কবার্তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।’
বন্যা সতর্কতায় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে মাইকিং চলছে। ছবি: নিউজবাংলা
এদিকে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের তিস্তা তীরবর্তী এলাকায় বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জনসাধারণকে সতর্ক করে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে দিনভর মাইকিং করেছে উপজেলা প্রশাসন।
বুধবার রাত ৯টার দিকে তিস্তার এ অঞ্চলে বিপৎসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গেল ২৪ ঘণ্টায় এখানে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩১ সেন্টিমিটার। বৃহস্পতিবার ভোর রাতের দিকেই তা সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিষয়টি নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক জানান, বৃহস্পতিবার ভোর রাতের দিকে অর্থাৎ আজ রাত ৪টা থেকে ৫টার দিকে তিস্তা নদীর পানি সুন্দরগঞ্জে বিপৎসীমা অতিক্রম করবে। এতে করে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়বে। উজানের পানির বেগ থেকে এই অনুমান করা হচ্ছে। একইসঙ্গে এক থেকে দুই দিন স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কার কথাও জানান নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক।
এদিকে তিস্তায় পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে নদী পাড়ের মানুষ। তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করলে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবে। যদি তা স্থায়ী হয় তবে, পানিবন্দি মানুষের বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য এবং পশু খাদ্যের সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে বন্যার পূর্ব প্রস্তুতি থাকার কথা জানিয়ে বন্যা মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
এ বিষয়ে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরীকুল ইসলাম মুঠোফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভারত থেকে পানি আসার খবরে উপজেলার সকল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ সচেতন মহল, সুধীজন ও প্রশাসনের বিভিন্ন ইউনিটকে নিয়ে জরুরি মিটিং করা হয়েছে। নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষদের সতর্ক করতে সকাল থেকেই মাইকিং করা হয়েছে। সর্বসাধারণকে গরু-ছাগলসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে সতর্ক থেকে নিকটস্থ বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র বা ফ্ল্যাট শেল্টারে অবস্থান নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। জরুরি যোগাযোগে নৌকার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চারজন অফিসারকে দায়িত্ব দিয়ে উপজেলা কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে। তারা ২৪ ঘণ্টা নিরবিচ্ছন্নভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। যেকোনো প্রয়োজনে সেখানে যোগাযোগ করা হলে তাৎক্ষণিক সব ধরনের সহযোগিতা করতে উপজেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে।’