সিলেটে বিএনপির বিরোধ ফের মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে। সম্প্রতি দলটির দুই নেতার বহিষ্কারকে কেন্দ্র করে বিএনপির পুরনো বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে।
মহানগর বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ও সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সালেহ আহমদ খসরু এবং সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক দিনার খান হাসুকে ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে বহিষ্কার করা হয়। কেন্দ্রীয় এক নেতার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ এনে এই পদক্ষেপ নেয় সিলেট মহানগর বিএনপি।
বহিষ্কৃত দুজনই বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরীর বলয়ের নেতা। তাদের বহিষ্কারের পেছনে চেয়ারপারসনের আরেক উপদেষ্টা খন্দকার মুক্তাদির আহমদ বলয়ের নেতাদের ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দুই নেতাকে বহিষ্কারের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আরিফুল হকও।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, সিলেটে বিএনপিতে বিভক্তি দীর্ঘদিনের। একসময় সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ও সাবেক সংসদ সদস্য এম. ইলিয়াস আলী বলয়ে বিভক্ত ছিলো দলটি। সাইফুর রহমানের প্রয়ান ও ইলিয়াস আলীর রহস্যজনক অন্তর্ধানের পর তাদের অনুসারীরাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
বর্তমানে সিলেট বিএনপি খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির ও আরিফুল হক চৌধুরী বলয়ে বিভক্ত। এদের মধ্যে আরিফুল হক চৌধুরী সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং খন্দকার মুক্তাদির গত নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে বিএনপির সংসদ সদস্য প্রার্থী ছিলেন।
সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনে সাম্প্রতিক সময়ে বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামে সিলেট বিএনপি। দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে আরিফ ও মুক্তাদিরকে এককাতারে অংশ নিতে দেখা গেছে। তবে দুই নেতাকে বহিষ্কারের ঘটনা কেন্দ্র করে সেই পুরনো বিরোধ মাথাচাড়া দিয়েছে।
সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির একাধিক নেতা জানান, মাঠে শক্ত অবস্থান থাকলেও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব আরিফুল হক চৌধুরীর ওপর অনেকটাই নাখোশ ছিলেন। এই সুযোগে স্থানীয় বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন খন্দকার মুক্তাদির। এসব কমিটিতে তার অনুসারীরাই শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হন।
দলের আপত্তির কারণে গত সিটি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে কেন্দ্রে নিজের অবস্থান অনেকটাই পুনরুদ্ধার করেছেন আরিফ। নির্বাচনে অংশ না নেয়ার পুরস্কার হিসেবে ১৬ সেপ্টেম্বর আরিফুল হককে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য থেকে পদোন্নতি দিয়ে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করা হয়।
আরিফ-ঘনিষ্ঠ দুই নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, খন্দকার মুক্তাদির দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকায় সিলেট বিএনপেতে তিনি ইচ্ছেমতো নিজের অনুসারীদের দিয়ে বিভিন্ন কমিটি বাগিয়ে নিয়েছেন। এখন আরিফুল হক চৌধুরীও মুক্তাদিরের সমান পদে আসীন।
আরিফুল হককে কোণঠাসা করতেই তার অনুসারী দুই নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
বিএনপির এই অংশের নেতাদের দাবি, মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি কেন্দ্রে জমা দেয়া হয়েছে। ওই কমিটিতে সালেহ আহমদ খসরু সহ-সভাপতি ও দিনার খান হাসু যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কমিটিতে আরিফ বলয়ের প্রভাব কমাতে কমিটি অনুমোদন ও ঘোষণার আগেই তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে।
২৪ সেপ্টেম্বর রাতে মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে সালেহ আহমদ খসরু ও দিনার খান হাসুকে বহিষ্কারের কথা জানানো হয়।
তাতে জানানো হয়, ২১ সেপ্টেম্বর সিলেট অভিমুখে রোডমার্চ করে বিএনপি। রোডমার্চ শেষে সিলেট নগরের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে সমাবেশ হয়। সমাবেশের আগের রাতে দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল মাঠ পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে কোনো কারণ ছাড়াই সালেহ আহমদ খসরু ও দিনার খান হাসু দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন, যা দলীয় শৃঙ্খলার পরিপন্থী। এ কার্যকলাপের কারণে তাদেরকে বিএনপির পদ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হলো।
ওই রাতে মাঠে উপস্থিত একাধিক নেতাকর্মী জানিয়েছেন, সমাবেশের কিছু বিষয় নিয়ে জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে আরিফুল হক চৌধুরীর উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। তাদের অনুসারী কয়েকজনও তাতে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় হাবিব উন নবী সোহেলও উপস্থিত ছিলেন।
বর্তমানে সিলেট মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। বহিষ্কৃত সালেহ আহমদ খসরু ৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির নির্বাহী সদস্য এবং কাউন্সিলর দিনার খান হাসু ১৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির নির্বাহী সদস্য হিসেবে রয়েছেন। হাসু সিলেট নগরের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর। দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে এবার নির্বাচনে অংশ নেননি তিনি।
বহিষ্কার প্রসঙ্গে দিনার খান হাসু বলেন, ‘একেবারে অগঠনতান্ত্রিক পন্থায় আমাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া আমাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোও সত্য নয়।’
সালেহ আহমদ খসরু বলেন, ‘আমাকে বহিষ্কারের পেছনে দলের বিরোধের প্রভাব থাকতে পারে। তবে যে অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে তা খুবই হাস্যকর। সেদিন এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তবে যার যা ইচ্ছা করুক, আমি আজীবন বিএনপি করে যাবো।’
এ প্রসঙ্গে আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘দল থেকে কাউকে বহিষ্কার করতে হলে আগে তাকে কারণ দর্শানো নোটিশ দিতে হবে। অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে এসবের কিছুই করা হয়নি। এটা বিস্ময়কর।’
খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে তার অনুসারী হিসেবে পরিচিত সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন বলেন, ‘বহিষ্কত দুই নেতা সেদিন কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’
গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। সালেহ আহমদ খসরু ও দিনার খান হাসু উভয়েই ওয়ার্ড কমিটির সদস্য। ওয়ার্ড কমিটির অনুমোদন দেয় মহানগর। তাই তাদের বহিষ্কারেরও এখতিয়ার রয়েছে মহানগর কমিটির।’