তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহর নিয়োগ ঠেকাতে মরিয়া সিন্ডিকেট। দীর্ঘদিন ধরে চলা নানা অপকর্ম, ঘুষ-বাণিজ্য ও লুটপাটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
দায়িত্ব গ্রহণের ২১ মাসের মধ্যেই ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৪৮৬টি বার্নার, ৫১৫টি শিল্প, ৫২৯টি বাণিজ্য, ১৭৯টি ক্যাপটিভ ও ৫৪টি সিএনজি গ্রাহকের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন তিতাসের এমডি। পাশাপাশি ৭৪৪ দশমিক ৪১ কিলোমিটার অবৈধ পাইপ লাইনও অপসারণ করেন।
এছাড়া ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মোট ৪০৪ কোটি ৬ লাখ টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি।
বিভিন্ন অনিয়ম ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের দায়ে ৫ জনকে বরখাস্ত, ১৪ জনকে সাময়িক বরখাস্তসহ মোট ১৮৯ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এছাড়াও ১ হাজার ৫০ জনকে বদলি করা হয়। আর এতেই এমডির ওপর রুষ্ট হন অবৈধ সুবিধা নিতে না পারা সিন্ডিকেটের সদস্যরা। নানা ধরনের বেনামি অভিযোগ দিয়ে এমডির সুনামহানির চেষ্টা করছেন তারা।
তিতাসের এমডি শনিবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার কোনোটিই সত্য নয়। এমনকি আমার সময়কালকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের জন্য গ্যাস বিল বকেয়া ও সিস্টেম লসের যেসব তথ্য প্রচার করা হচ্ছে সেসবও ভুয়া। তদন্তেই বেরিয়ে আসবে প্রকৃত তথ্য।’
তিতাসের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বকেয়া গ্যাস বিলের পরিমাণ ছিল ৬৯৫০ কোটি ৪ লাখ টাকা। আর বকেয়া মাসিক গড় বিলের পরিমাণ ছিল ১৫১০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা এবং বকেয়ার সমতুল্য মাস ৪ দশমিক ৬০।
এছাড়া ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত বকেয়া গ্যাস বিলের ১১,৩৫০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, মাসিক গড় বিলের পরিমাণ ৩০৯৩ কোটি ৭৮ লাখ এবং বকেয়ার সমতুল্য মাস ৩ দশমিক ৬৭। চলতি বিল (আগস্ট ২০২৩ মাসের ৩,১৯৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা) বাদে মোট বকেয়া ৮,১৫৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা এবং বকেয়ার সমতুল্য মাস ২ দশমিক ৬৮।
এমডি হারুনুর রশীদ একইভাবে সিস্টেম লসও কমিয়ে আনার চেষ্টা করছিলেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সিস্টেম লস ছিল ১৩ দশমিক ৭০ ভাগ। সেখান থেকে তা ২০২০-২১ সালে ১২ দশমিক ৪৪ ভাগ, ২১-২২ সালে ১০ দশমিক ৬১ ও ২২-২৩ সালে ৭ দশমিক ৮৯ ভাগে কমিয়ে আনেন।
ব্যবস্থাপনা পরিচালকের এসব সাফল্যকে আড়াল করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তিতাস ও সরকারের সাফল্যকে ম্লান করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান তারা। অসাধু সিন্ডিকেটের সদস্যরা নামে-বেনামে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠান। সেগুলো বিভিন্ন সাংবাদিকের কাছে সরবরাহ করে ভিত্তিহীন ও অসত্য খবর প্রকাশের মাধ্যমে এমডির তৃতীয় দফার নিয়োগ বাতিল করতে তারা মরিয়া।
সম্প্রতি তিতাস কর্তৃপক্ষ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গুজব রটানো এবং সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের লোকজনকে জড়িয়ে মিথ্যা তথ্য সরবরাহকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়।
তিতাসের কর্মকর্তারা আরও জানান, মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ এমডি হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার পরপরই অনিয়ম দূর করতে নানা পদক্ষেপ নেন। অবৈধ সংযোগপ্রদান ও গ্রহণকারীদের তালিকা করে তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে থাকেন। এতেই একটি পক্ষ তার ওপর রুষ্ট হয়। তারা এমডিকে হেয়প্রতিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য নামে-বেনামে অভিযোগ দিতে থাকে। এসব বিষয় তদন্তাধীন থাকা সত্ত্বেও এমনকি প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় তিতাস গ্যাস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির পক্ষ থেকে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগের পাশাপাশি একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানে তিতাস গ্যাসের সংযোগ প্রদানসহ নানাবিধ অনিয়ম’ শীর্ষক খবরের বিপরীতে তিতাস গ্যাস টিঅ্যান্ডডি কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষে একটি বক্তব্য দেয়া হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, যে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে করা হয়। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করার সংবাদটি মিথ্যা, বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার।
কর্মকর্তারা জানান, অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিরুদ্ধে তিতাস গ্যাসের অভিযানে যাদের স্বার্থহানি হয়েছে, সেসব স্বার্থান্বেষী মহল বা ব্যক্তি উদ্দেশ্যমূলকভাবে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হারুনুর রশিদ মোল্লাহ ২০২১ সালে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। দ্বিতীয় দফায় তিনি আরও এক বছরের জন্য নিয়োগ পান। তিনি তিতাসে দীর্ঘদিন ধরে চলা অনিয়ম দূর করতে নানা পদক্ষেপ নেন। এতেই দুর্নীতিবাজ চক্রটির চক্ষুশূলে পরিণত হন তিনি।
আর তৃতীয়বারের মতো দায়িত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়া আটকে দিতে এমডির বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রসহ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ প্রকাশের পথ বেছে নেয় চক্রটি। ইতোমধ্যে চক্রটির সঙ্গে জড়িতদের বিষয়েও খোঁজখবর নিয়ে তালিকা করা হচ্ছে বলে জানান এক কর্মকর্তা।
প্রসঙ্গত, আব্দুল লতিফ নামে এক ব্যক্তির মিথ্যা অভিযোগ সামনে এনে চক্রটি এমডির নিয়োগ ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভুক্তভোগী দাবিদার আব্দুল লতিফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এমডি হারুনুর রশিদ মোল্লাহ বলেন, ‘অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিরুদ্ধে তিতাস কর্তৃপক্ষের অভিযানে যাদের স্বার্থহানি হয়েছে, সেই সিন্ডিকেটের সদস্যরাই আমার বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নানা কল্পিত অভিযোগ ও অপপ্রচার চালাচ্ছে।
‘গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আমাকে জড়িয়ে অপপ্রচার চালিয়ে তিতাস নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে সরকারের সাফল্য ম্লান করার অপচেষ্টায় রয়েছে সরকারবিরোধী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরাই মিথ্যা তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে আমাকে সামাজিকভাবে হেয় করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। ‘পুরো কর্মজীবনে আমি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে এসেছি। তাই তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এই অপপ্রচারকারীদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছি।’